বছরে মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। গত ১৪ বছর প্রতি ঈদের আগেই বিএনপির ঘোষণা ছিল ‘ঈদের পরেই চূড়ান্ত আন্দোলন’। রাজনীতির মহল থেকে সাধারণ জনতা- সবার কাছেই তাদের এই ঘোষণা হাস্যরসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারের অক্টোবর মাস ঘিরে রাজনীতিতে নানা জল্পনা-গুঞ্জন চলতে থাকলেও পরিস্থিতি সেই ‘ঈদের পরের আন্দোলনের’ মত হয়ে গেছে। মাসের শুরুতেই দীর্ঘ দিনের আলোচনা থামিয়ে দিয়েছে বিএনপি। ‘নভেম্বরে দ্বাদশ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে’ ধরে নিয়ে কয়েক মাস ধরে নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায়ে অক্টোবরকে টার্গেটের কথা বলে আসছিল দলটি। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ স্বতস্ফূর্ত হওয়ায় অক্টোবরে ‘কিছু একটা’ ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। তবে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। গত ৫ তারিখে চট্টগ্রামে রোডমার্চ সমাপ্তির সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার কারণে কর্মসূচিতে বিরতি দেওয়ার কারণে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি এই অক্টোবরে দাবি আদায়ে আর কোন যুৎসই পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শুধু বিএনপি নয়, একদফা দাবি আদায়ে বিএনপির সঙ্গে থাকা সমমনা অন্য দলগুলোও একইভাবে বিরতি দেবে ও কর্মসূচি পালন করবে।
এ নিয়ে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের সীমা অতিক্রম করে গেছে। এই সরকারে অতিষ্ঠ জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চূড়ান্ত ফল আশা করছে। এই প্রত্যাশাকে বিবেচনায় রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন করবেন রাজনীতিকরা।’
তিনি জানান, ১৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর পূজার কারণে কয়েকদিনের বিরতি থাকায় দলীয় নেতাকর্মী, অনুসারীদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য আবারও ঢাকামুখী কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে মহাসমাবেশ করা হবে।
গত ৫ অক্টোবর কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন ছয় দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- আগামী ৭ অক্টোবর ঢাকায় শিক্ষক সমাবেশ, ৯ অক্টোবর খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা-মহানগরে সমাবেশ ও মিছিল, ১২ অক্টোবর ঢাকায় ছাত্র কনভেনশন, ১৪ অক্টোবর খালেদা জিয়ার ইস্যুতে ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা-মহানগরে অনশন, ১৬ অক্টোবর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ঢাকায় যুব সমাবেশ এবং ১৮ অক্টোবর ঢাকায় জনসমাবেশ।
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিগুলো পালনের পর ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর দুর্গাপূজার উৎসব রয়েছে। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বিএনপি কোনও ধরনের কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৮ অক্টোবরের ঢাকার জনসমাবেশ থেকে কিছু দিনের সময় দিয়ে সরকারকে দাবি মানতে আল্টিমেটাম দেওয়া হবে। আল্টিমেটাম শেষে ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেবে বিএনপি। সেই মহাসমাবেশ অক্টোবরের শেষে অথবা নভেম্বরের শুরুতে হবে।
বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা জোট গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা জানান, মহাসমাবেশ থেকে তফসিলকে কেন্দ্র করে এর আগে ও পরের পুরো সময়টিতে টানা কর্মসূচি দেওয়া হবে। এটাই হবে সরকার পতনের চূড়ান্ত কর্মসূচি।
বিএনপির আন্দোলন পরিকল্পনায় যুক্ত থাকা এক নেতা বলেন, আল্টিমেটাম থেকে মহাসমাবেশ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সরকারের হাবভাব বুঝতে চায় বিএনপি। আশানুরূপ কিছু না দেখলে মহসমাবেশ থেকেই সরকার পতনের টানা কর্মসূচি হাতে নেবে বিরোধী দলগুলো। এসব কর্মসূচির মধ্যে থাকবে সচিবালয় ঘেরাও, ঢাকা অভিমুখে রোডমার্চ, অবরোধ ইত্যাদি। তবে অক্টোবর ঘিরে যে আলোচনা চলছিল, সেই টার্গেটে পরিবর্তন এসেছে।
ওই নেতা জানান, নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য সময় ধরে নিয়ে এর আগেই কঠোর আন্দোলনের পরিকল্পনা ছিল। তবে দু’জন এমপির মৃত্যুর কারণে দুটি শূন্য আসনে নভেম্বরের ৫ তারিখ উপনির্বাচনের ভোট। এরপরে সপ্তাহখানেক বা ১০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং, হাতে কিছুটা সময় আছে। তবে তফসিল ঘোষণার আগেই শেষ খেলা খেলতে চায় বিএনপি, যা গড়াবে নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল গণমাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, বিএনপির ঈদের পর, পূজার পর, পরীক্ষার পর কঠোর আন্দোলনের হুমকি আজ জনগণের কাছে উপহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাদের সব তর্জন গর্জন, হুংকার আষাঢ়ে গল্পের মতোই হাস্যকর। বিএনপি যতবার আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, জনগণ ততবারই তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দেশ বর্তমানকে বলেন, আমরা যে কর্মসূচি দিয়েছি, সেই কর্মসূচিতেই থাকব। আমাদের আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ। আমরা মনে করি, আমাদের কর্মসূচিতে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি হলে সেই আন্দোলন সফল হবে। আমরা কোন সহিংস আন্দোলনে যাব না।
এক প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র এই বিএনপি নেতা বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সেটা নভেম্বর পর্যন্তও গড়াতে পারে। পরিস্থিতি অনুযায়ী দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘চূড়ান্ত কর্মসূচি বলে রাজনীতিতে কিছু নেই। চূড়ান্ত কিছু কবে আসবে, কবে হবে, এসব তো দিনক্ষণ বলে-কয়ে আসে না।’