নতুন বাজেট উত্তাপ ছড়াচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে মাছ-মাংস, ডিম, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। ফলে বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। এমনিতেই গত এক বছরে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ।
নতুন অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বড় অংকের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রাজস্ব বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিল আইএমফের শর্ত থাকায় এনবিআরকে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন তিনি। রাজস্ব আদায়ের ছক কষতে গিয়ে পরোক্ষ করের পরিমাণ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আরো চাপে ফেলে দেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের উর্ধ্বমুখী দামে সংসার খরচ দিন দিন বাড়ছেই। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া কোথায় গিয়ে থামবে, কে থামাবে তা জানতে বাজেটের দিকে চোখ ছিল অনেক মধ্যবিত্তের। তারা চেয়েছিলেন হয়তোবা বাজাটে নিত্যপণ্যের দাম কমবে। চেয়েছিলেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। তারা ভেবেছিলেন আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষ্যে হয়তোবা জনতুষ্টির কথা ভেবে অর্থমন্ত্রী নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মধ্যবিত্ত শ্রেণী তথা সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের চাপে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাপক হারে নিত্যপণ্যের ওপর করারোপ করেছেন। তাতে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বাজেটে ভ্যাট হারে ব্যাপক পরিবর্তন আনার মাধ্যমে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী যেমন- কলম, তৈজসপত্র, রূপচর্চা সামগ্রী, রান্নার এলপি গ্যাস, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে স্বর্ণালংকার, বাড়ি নির্মাণ সামগ্রী, সিমেন্টের দাম বাড়বে। কলম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যহতি ছিল, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। আবাসিক গ্যাস সংকট থাকায় এখন এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সেখানেও নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এলপি গ্যাস উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিলিন্ডার বানানোর কাজে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েলন্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তখন বাজেটে বিষয়টিকে অনেকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পণ্যের ভ্যাট বাড়লে তা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেবেই। কারণ চূড়ান্তভাবে ক্রেতাকেই ভ্যাটের ভার বহন করতে হয়। ভ্যাটের হার না বাড়িয়ে ফাঁকি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া গেলে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যেত। এতে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ে চাপ পড়ত না।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য বিশ্ববাজারকে দায়ী করার যে প্রবণতা দেখা যায়, সেটি এখন আর যৌক্তিক নয় বরং মূল্যস্ফীতি এখন দেশীয় কারণেই বেশি হচ্ছে। সরকার যেমন ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, তেমনি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিয়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে কমানো হচ্ছে না। বরং এ খাত থেকে ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নিয়ে মুনাফা করছে সরকার।
দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম অর্ধেকে নেমে এলেও দেশে তার সুফল নেই। শুধু সয়াবিন তেল নয়, গম, মসুর ডাল, জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই রকম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও তাদের খরচ ততটা কমেনি। কারণ, দেশে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় পরিবহন খরচও বেড়েছে।
এদিকে চলতি বছরের মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে হয়েছে। গত ১২ বছরের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। আর গত বছরের আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ তথ্য জানিয়েছে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, মে মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে। সাধারণত খাদ্যপণ্যের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি থাকে। এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস।
এ ছাড়া বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন ও শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ছে। মে মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা এপ্রিলে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রামের চেয়ে শহরে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়। মে মাসে দেশের গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং শহরে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
গত মে মাসে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালের মে মাসে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন, চলতি বছরের মে মাসে একই পণ্য কিনতে তাঁর খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা। মূল্যস্ফীতি হলো একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে মাছ-মাংস, ডিম, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। গত কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহ আগে ৩০ টাকায় বিক্রি হওয়া শসার দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। ২০ টাকার আলুর কেজি এখন ৪৫ টাকা। পেঁয়াজের কেজি পৌঁছে গেছে ৯০ টাকায়। পেঁয়াজ আমদানি ঘোষণায় এখন কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি করলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, বরবটি প্রতি কেজি ৬০ টাকায়, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ৫০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, টমেটো ৮০ টাকা, পটল ৫০ টাকা, পেঁপে ৫০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, কাঁকরল ৬০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং জালি কুমড়া প্রতি পিস ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, অনেক সবজির মৌসুম শেষ হয়ে গেছে, তাই বাজারে সরবরাহ কম। নতুন সবজি উঠতে শুরু করলে দাম আবার কমে আসবে।
বাজারে সবজির দাম ঊর্ধ্বগতি থাকলেও কিছুটা কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। গতকাল বাজারভেদে প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়, তবে কিছু কিছু স্থানে এর চেয়ে কম দামেও বিক্রি হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে প্রতি হালি ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। প্রতি কেজি দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৬৮০ টাকায়।
ডিমের মতো দাম বেড়েছে গরুর মাংসের। প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। অন্যদিকে খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা কেজি দরে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির একই চিত্র দেখা গেছে মাছের বাজারেও। প্রকারভেদে চাষের মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৫০ থেকে ২০০ টাকা। অন্যদিকে ইলিশ-চিংড়ির পাশাপাশি দেশি পদের মাছের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা।
চাষের পাঙাশ-তেলাপিয়া থেকে শুরু করে দেশি প্রজাতির সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। আগে বাজারে প্রতি কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হতো ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, যা এখন ২২০ থেকে ২৩০ টাকায় ঠেকেছে। অন্যদিকে তেলাপিয়া মাছের কেজি হয়েছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। যা আগে কেনা যেত ১৮০-২০০ টাকায়।
বাজারে তেল, চিনি, আটা-ময়দা বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। রয়েছে কিছু পণ্যের সরবরাহ সংকটও। যেমন- প্যাকেটজাত চিনি ও ময়দা অধিকাংশ দোকানে নেই। বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও মুদি দোকানিরা বলছেন ঘাটতি আছে। দোকানে প্রতি কেজি চিনি ১৪০ টাকা ও সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিকে বিনিয়োগে নানা শর্ত দেওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের আয়ের মানুষেরা সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে বেশি পরিমাণে ভাঙানোর দিকে ঝুঁকছেন বলে জানিয়েছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর । চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) ৬৮ হাজার ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭১ হাজার ৬১৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস ৬৮ হাজার ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকার পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। তবে তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ ও আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে তিন হাজার ৫৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা শোধ করেছে।
সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সে কারণেই নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে। সরকারকে কোষাগার থেকে সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এমএফ