বাজারের আঁচে ঝলসানো জীবন
রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় থাকবে-মন্ত্রী আমলারা এ কথায় মানুষকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ সরকারি সংস্থাগুলো দফায় দফায় বৈঠক করছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রমজানে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি মনিটরিং করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন। রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর লক্ষ্যে ৮ বিভাগীয় কমিশনারদের সাথে রোববার বৈঠকে বসেছেন ক্যাবিনেট সচিব। দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাও অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ সভায় ৮টি পণ্য যথা পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসুর, ডাল, চাল, গম, আটা, চিনি এবং ভোজ্য তেল নিয়ে চাহিদা যোগান এবং এলসি নিষ্পত্তির ব্যাপার আলোচনা হবে বলে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন।
নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিন না হলেও কয়েকদিন পরপর বাড়ছে, রমজানের কয়েক মাস আগে থেকেই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মানুষ দ্রব্যমূল্যের চাপে ক্রমেই দিশেহারা এবং হতাশ হয়ে পড়ছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং সরকার ও প্রশাসনের দুর্নীতিসহ নানা রাজনৈতিক দাবিতে সারা দেশে সভা সমাবেশ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। সমাবেশগুলোতে প্রচুর লোকজনও হচ্ছে। কয়েক মাস যাবত লাগাতার মিটিং মিছিল সমাবেশ পদযাত্রা তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিএনপির সমালোচনার রাজনৈতিক জবাব দিলেও দ্রব্যমূল্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তারা বেকায়দায় আছেÑএটি মানতেই হবে। অন্যান্য বিরোধী দলও দ্রব্যমূল্য ইস্যুতে সরব। মন্ত্রী-আমলা-সরকারি দলের নেতারা যতই রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতির কথা বলুন না কেন জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছেনা। ফলমূল, সবজি, চাল, মাছ, মাংস এসব উৎপাদনে দেশ অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও ক্রমাগতই এসব পণ্যের দাম বাড়ছে, এই বাড়ার কোন সন্তোষজনক জবাব সরকারের কাছে নেই।
দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের এতসব তৎপরতা বাজারে কোন ফল দিচ্ছে না। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা সরকারকে যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। সরকারের এত নজরদারির মধ্যেও ব্রয়লার মুরগির দাম ২৮০ টাকার কাছাকাছি গিয়েছে মর্মে গণমাধ্যম খবর দিয়েছে। ঢাকার বাজারের বরাত দিয়ে একটি জাতীয় পত্রিকা লিখেছে ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায়, আর সোনালী মুরগির খুচরা দাম ৩৭০ থেকে ৩৮০ টাকা। ছোট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মুরগি ও ডিমের বাজার বড় ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এটি বাংলাদেশ পোলট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতিরও। আর জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া তাদের প্রতিবেদনে বলেছে পোলট্রি ফিডের মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য আইটেমের ব্যয় বাড়ার পর এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন ব্যয় করপোরেট পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা, প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা আর উৎপাদন খরচ অনুযায়ী প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম সর্বোচ্চ ২০০ টাকা হতে পারে। সরকারের একটি সংস্থা এই হিসাব দিয়েছে তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাজার স্বাভাবিক করার দায়িত্ব কার?
এর আগেও মুরগির ডিমের মূল্যবৃদ্ধিতে কিছু বড় ব্যবসায়ীর নাম সরকার পত্রিকায় ছাপিয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে একই কথা বলা যায়। সরকার থেকে ভোজ্য তেলের জন্য কয়েকটি বড় আমদানিকারক পরিশোধনকারী গোষ্ঠীকে দায়ী করা হলেও তাদের কিছুই করা যায়নি। নিত্যপণ্য যেমন টয়লেট্রিজের যেমন সাবান-ডিটারজেন্ট ও অন্যান্য কয়েকটি আইটেমের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকার কয়েকটি বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করেছে কিন্তু ঐ পর্যন্তই, কোনটিরই দাম কমেনি। তাহলে মিটিং করে কী লাভ হবে! ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চাহিদা যোগান আমদানি নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে কীভাবে!
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানান উৎসবে পণ্যের ওপর বিভিন্ন ছাড় দেয় মর্মে ব্যবসায়ীদের বলেছেন, তিনি রমজান মাসের যৌক্তিক দাম রেখে লাভ কম করতে বলেছেন। প্রতিবছরই সরকার থেকে এসব কথা বলা হয় কিন্তু ব্যবসায়ীরা পুণ্য লাভের চেয়ে মুনাফা অর্জনকেই গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন গণমাধ্যমে বলেন, ইসলামী দেশগুলোতে সরকার ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দেয়, তাই তারা রোজার সময় পণ্যের দাম কমিয়ে রাখে।
আমাদের দেশে কী এই ব্যবস্থা আছে? (প্রতিদিনের বাংলাদেশ ১৯ মার্চ), সরকার করোনার সময় থেকেই শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের নগদ প্রণোদনা দিয়েছে খেলাপি ঋণের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা সত্ত্বেও নমনীয় থেকেছে। বিভিন্ন মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় রাখতে ভ্যাট, নানা ট্যাক্স কমিয়েছে, কর অবকাশ, দিয়েছে এলসিতে সুবিধা দিয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সুবিধা দিয়েছে। এগুলি কি ভর্তুকি নয়? তারপরও কি ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমিয়েছে?
সম্প্রতি টাস্কফোর্সের সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে নিত্যপণ্যের মজুত পর্যাপ্ত, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না। নিত্যপণ্যের দাম তো আগেই বেড়ে গিয়ে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে গিয়ে স্থিতিশীল হয়েছে, সামনের কয়দিনের অবস্থা কি হবে বলা যাবে না। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা সরকারের সাথে বৈঠকে পণ্যের কোনো সংকট হবে না বলে থাকেন কিন্তু বাজারে তার কোন নমুনা দেখা যায়না, তাদের এসব বক্তব্য আইওয়াশ।
শুধু খাদ্যপণ্য বা কিছু নিত্যপণ্য নয়, রমজানে মানুষ কাপড় চোপড়, প্রসাধনী, জুতা, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন। এসবের দাম শুনে মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এসবে কোনো নজরদারি নেই, যে যেভাবে পারে ক্রেতাকে ঠকাবে। ক্রেতারও উপায় নেই। তাকে কিনতেই হবে স্বজনদের জন্য প্রয়োজনীয় আইটেম। গরম, ভিড়, জ্যাম, পকেটমার, ছিনতাইকারীর দল থেকে রেহাই পেতে দরদাম করার আর সুযোগ থাকে না। দোকানী এই সুযোগে গছিয়ে দেয় মাল।
ধর্মকর্ম পালনের ক্ষেত্রে এই মাসে স্বস্তি প্রয়োজন। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি কী রোজাদারদের মানসিক শান্তি দিতে পারছে। মন্ত্রীর আমলারা প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সিন্ডিকেটের কারসাজি নিয়ে কথা বলছেন কিন্তু বাজারে কোনো প্রভাব পড়ছেনা বরং ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভাঙছেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই পেড়ে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, শিল্পপতিরা ঝালমুড়ি, চানাচুর, নুডলস, মসল্লা, চাল, রুটি, মুরগি ডিম থেকে নিত্যপণ্য, ফ্ল্যাটবাড়ি, জীবনযাপনের সকল অপরিহার্য পণ্যের ব্যবসা তাদের হাতে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো মার খেয়ে যাচ্ছে।
কর্পোরেট সংস্থা মধ্যস্বত্বভোগী কিছু এজেন্ট নামিয়ে দিয়েছে মাঠে, এরা কৃষক-চাষির কাছ থেকে কমমূল্যে তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে দিচ্ছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান কৃষক-চাষিদের আগে থেকেই টাকা দিয়ে তাদের পণ্য কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করে রাখে। এতে কৃষক দর কষাকষির সুযোগ পায়না, অভাবের সময় নেয়া টাকায় প্রতিষ্ঠানের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা পণ্যের দাম ঠিক করে, কখনো মজুত করে, কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, বাজারকে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কব্জায় নিয়ে নেয়। চাষিরা ঠকে, ভোক্তারা প্রতারিত হন। সরকার এদের কিছুই করতে পারে না।
সরকার রমজানে পণ্যের দাম যাতে না পড়ে সে ব্যাপারে বাজার তদারকির নির্দেশ দিয়েছে মাঠ পর্যায়ে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাঝে মাঝে অভিযান, কিছু জরিমানা দিয়ে কী বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সমস্যার মূলে কাদের কারসাজি তা তো সরকারের অজানা নয়, সরকার দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারছে না, বাজারও স্বাভাবিক হবেনা। প্যাকেটে বা মোড়কে প্রতি সপ্তাহে মূল্যবৃদ্ধির লেবেল ছাপিয়ে পণ্য বাজারে ছাড়া হচ্ছে, বিএসটিআই কি করছে? আমদানিকারক, আড়তদার পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী সকলেই ভোক্তাকে নাজেহাল করতে একাট্টা। মূল্য তালিকা কোথাও নেই।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিয়ত মূল্যবৃদ্ধির আঁচে ঝলসে যাচ্ছেন। মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বাজারকে একেবারে অস্বাভাবিক করে তুলছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার কথাটি অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে আছে, বাজারে দৃশ্যমান নয়। মানুষ ভয়ানক কষ্টের মধ্যে আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা, বিনোদন, বিশ্রাম, সামাজিক সম্পর্ক-এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি সংসার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
লেখক : সাংবাদিক