পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু সংখ্যা, সরকারের পদক্ষেপ কী ?

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। শুধুমাত্র এ মাসেই এখন পর্যন্ত ৩৬ জন মারা গেছেন। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে এখনই ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড়। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দেখা যায় গত কয়েক মাসের তুলনায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে সে বিষয়ে আরো দুই মাস আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এখনো যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে, অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিবছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন তারা এটাকে চাকরি হিসেবে দেখছে, সেবা ও ভালোবাসার আন্তরিকতাপূর্ণ সহাবস্থানের অনুপস্থিতিও ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

একইসঙ্গে রোগীর অসচেতনতা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর যথাযথ চিকিৎসা না করেই অন্য হাসপাতালে রেফার করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের দুর্বলতা প্রতিবছরই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপ শক সিনড্রোম নিয়ে বেশিরভাগ রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।

প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, তাহলে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুই সিটি করপোরেশন কী পদক্ষেপ নিয়েছে? গত বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মাথায় রেখে এ বছর যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা পরিস্থিতি সামলাতে আসলে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে?

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ সামলাতে সাধারণ ওয়ার্ডের বাইরেও আলাদা করে সিঁড়ির কাছে রোগীদের জন্য বেডের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এ হাসপাতালে পূর্ণবয়স্ক রোগীদের একটি ফ্লোরে, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য আলাদা ফ্লোরে ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গোড়ানের বাসিন্দা দুই বছরের শিশু ফারিয়াকে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর গত শুক্রবার এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত বুধবার ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ফারিয়ার। কিন্তু শুক্রবার অবস্থা বেশি খারাপ হলে এই হাসপাতালে আনা হয় বলে জানান শিশুটির বাবা নির্মাণ শ্রমিক মো. ফোরকান।

ফোরকান জানান, পাঁচ দিন ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসা হইছি। শুক্রবারে যখন এখানে আনি তখন বাচ্চার শরীর পুরা নেতায়ে গেছিল। কিছু খাইতোনা, খালি বমি করত পরে এখানে ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করতে বলে। আজকে (বুধবার) বাসায় চলে যেতে বলছে ডাক্তাররা।

তিনি জানান, তবে হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে অভিযোগ না থাকলেও সরকারি হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও স্যালাইন, নেবুলাইজার সবকিছু বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে।

গত পাঁচ মাসের তুলনায় এ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। একইসঙ্গে এ হাসপাতালে এ মাসে এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গত অগাস্ট মাসে আট জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

এ বছর অগাস্টের পুরো মাসে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার আটশো’র বেশি রোগী। আর এ মাসে এখন পর্যন্ত দুই হাজার দুইশো’র বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. সত্যজিত সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, এখন একশ একজন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় তিন থেকে চারশো রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। গতমাসের তুলনায় এ মাসে ক্রমাগত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

তিনি বলছেন, তবে গত বছর বাংলাদেশ ডেঙ্গুতে যে পরিস্থিতি দেখেছে তার তুলনায় রোগী তুলনামূলকভাবে এখনো কম। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাত এবং জলাবদ্ধতা ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে মনে করছেন এই চিকিৎসক।

এই চিকিৎসক বলেন, বেশিরভাগ রোগীরা ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ শক সিনড্রোম অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের ব্লাড প্রেশার কমে যাচ্ছে, মাল্টিপল অর্গানে কিছু ডিসফাংশন চলে আসছে, বমি হচ্ছে, শরীরে পানি চলে আসছে, কিছুটা ল্যাথার্জিক এমন অবস্থা নিয়ে আসছে।

তার ভাষ্য, পূর্ণবয়স্ক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি হলেও শিশু রোগীর সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে অনেক। মোট রোগীর ৩০ শতাংশ শিশু।

মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশেই ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যুর রেকর্ড নেই। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন বাংলাদেশে অসচেতনতার কারণে রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম, জ্বর নিয়ে অবহেলা করে ফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হতে দেরি হয়।

একইসঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, প্রথমত রোগীর সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। দ্বিতীয়ত গত বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যেসব কারণ সেগুলো কিন্তু দূর হয়নি।

তিনি বলেন, যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা যেটা আছে আমাদের সেটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এছাড়া যারা শনাক্ত হচ্ছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নয়, তাদেরকে মাঠপর্যায়ে হাসপাতালে রাখার কথা, আবার যারা জটিল রোগী তাদেরও একসঙ্গে রাখা হচ্ছে, ফলে তারা যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সব একজায়গায় হওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। যতই ডাক্তার দেন, স্যালাইন দেন, ফ্লোরে রোগী রেখে কি সমাধান করা যায় নাকি? কাজেই চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা খুব দরকার।

অনেকক্ষেত্রেই রোগীকে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে জেলা কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হয়। এতে মধ্যবর্তী সময়ে অনেক রোগী প্লাটিলেট কমে গিয়ে মুমূর্ষু হয়ে যায়। অন্তিম অবস্থায় চিৎসা পাওয়া এসব রোগীকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, একটি ডেঙ্গু রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই চিকিৎসা দিতে পারে। অথচ তা না করে জেলা হাসপাতালে ট্রান্সফার করে বা বিভাগীয় হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দেয়। এতে যে টাইম লাগে এতে রোগীর প্লাজমালি কেইস হয়ে যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায়। কমে গিয়ে এই রোগীটির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নিতে হবে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেটি সবাই জানে। কিন্তু প্রতিবারই আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। প্রতিবারই বলছি আমরা কাজ করছি, এটা করছি, সেটা করছি। কিন্তু নাগরিকরা ফলাফল পাচ্ছে না।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ ঘটাতে হবে বলে মনে করছেন এই কীটতত্ত্ববিদ।

তিনি বলেন, সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান বা যারা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে তাদেরকে চাকরি নয় বরং সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে তিনটি ব্যবস্থার কথা জানান এই অধ্যাপক। এর মধ্যে হটস্পট ম্যানেজমেন্টের আওতায় যেসব বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে সেখানে ২০০ মিটারের মধ্যে ক্রাশ কর্মসূচি করতে হবে। উড়ন্ত এডিস মশাগুলো এবং লার্ভা ধ্বংস করতে হবে। ফলে ওই বাড়িতে বা আশেপাশের বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হবে না।

দ্বিতীয়ত, সারা ঢাকাতেই লার্ভা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইডিংয়ের বিষয়টাকে জোর দিতে হবে।

তৃতীয়ত, এডিস মশার প্রজনন-স্থল ধ্বংস করতে হবে।

সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ কী?

বিগত বেশ কয়েক বছরে এডিস মশার বিস্তার রোধ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সমালোচনার মুখে পড়েছিল। গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু দেড় হাজারের বেশি ছিল। যা দেশের অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে।

বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ছয় জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই ছয় জনই ঢাকার দুই সিটির বাসিন্দা।

এ নিয়ে চলতি মাসের ১৯ দিনে এখন পর্যন্ত ৩৯ জন মারা গেছেন। রোগী শনাক্ত হয়েছেন নয় হাজার ১২৫ জন। এ বছর বুধবার (১৮ই সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ১২২ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। রোগী শনাক্ত হয়েছে ২১ হাজার ৯৬৬ জন।

মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কী পদক্ষেপ? জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবীর এ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলেন।

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানকে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি তিনি।

এদিকে, উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মশা নিধন কর্মসূচি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রমসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ডিএনসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, আমাদের যে রেগুলার একটিভিটিস সেগুলা চালু আছে। আর আগামীকাল থেকে ডিএনসিসির প্রতিটি অঞ্চলে সাত দিনব্যাপী ক্রাস প্রোগ্রাম করতেছি। এতে অ্যাওয়ারনেস অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ ইন্টারভেনশন দুই ধরনের কাজ থাকে।