ছাপার উদ্ভাবক হিসেবে আমরা ‘গুটেনবার্গকে’ চিনি। তিনি ছিলেন একাধারে জার্মান উদ্ভাবক এবং প্রকাশক যিনি ইউরোপে মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে ইউরোপে মুদ্রণ ব্যবস্থা চালু করেন। ইউরোপে প্রিন্টিং বিপ্লব শুরু হওয়ার পর মানব ইতিহাসের দ্বিতীয় সহস্রাব্দের একটি মাইলফলক তৈরি হয়। গুটেনবার্গের এই উদ্ভাবন বইয়ের জগতে একটি বিপ্লবের সূচনা করে। তার মুদ্রণ আবিষ্কারে সেদিন হতে বই সহজলভ্য হতে শুরু করলো। পশ্চিমের দেশগুলি বইয়ের শক্তিকে কাজে লাগালো। সেখানকার মানুষ বইয়ের পেছনে পাগলের মতো ছুটতে লাগলো। ভালমন্দ কিছু একটা করতে হবে এমন একটি আকাক্সক্ষা নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো জ্ঞান সমুদ্রে। আর তাতে করে খুব দ্রুত পশ্চিমের দেশে বইয়ের বিপ্লব ঘটে গেল। জ্ঞান সমুদ্রে পশ্চিমাদের এই ঝাপিয়ে পড়ার ফলস্বরূপ সেখানে দ্রুত জ্ঞানের বিস্তার ঘটেছে, অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে।
কিন্তু মুদ্রণ শিল্পের বদৌলতে বই যখন সহজলভ্য হতে শুরু করলো, তখন আমরা মুদ্রিত বইকে কাজে লাগাতে পারলামনা। ইউরোপে যেভাবে বই বিপ্লব ঘটে গেল, সেভাবে আমাদের দেশে ঘটেনি। আমরা পিছিয়ে পড়লাম, আমরা বুঝতে পারিনি, বুঝার চেষ্টাও করিনি। বুঝতে না পারার খেসারতটা আজকের দিন পর্যন্ত আমাদেরকে গুণতে হচ্ছে। একসময় আমরা পরিণত হলাম পাঠবিমুখ জাতি হিসেবে এবং সেটা বছর পরম্পরা অবধি চলে আসছে।
আমরা যারা পাঠাগার পরিচালনা করি। বই ও পাঠাগার নিয়ে কাজ করি, আমরা পাঠকের আগ্রহের বাস্তবতা উপলদ্ধি করতে পারি। আমাদের দেশের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীদের চাওয়া হলো, শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ এবং একটি চাকুরি প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট বইগুলো পড়ে কিছু একটা অর্জন করা। পাঠ্য বইয়ের বাইরে তারা সহসা অন্য বইগুলো পড়তে আগ্রহ দেখায়না। তারা বুঝতে চায়না জ্ঞানের বিশাল পরিধি সম্পর্কে। পাঠ্যবই কেবলমাত্র নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে জ্ঞান দেয়। কিন্তু বহুমুখী জ্ঞান দিতে পাওে না। বহুমুখী জ্ঞানার্জন করতে হলে পাঠ্য বইয়ের বাইরের হাজারো বইয়ের ধারস্থ হতে হবে। কিন্তু এদেশে সেটি সম্ভব হলোনা। সাধারণ মানুষ বইমুখী হয়ে ওঠতে পারেনি। নিজেদের সন্তানদেরকে পাঠমুখী করে গড়ে তুলতে পারেনি। এখানে আমাদের ব্যর্থতা।
আমাদের দেশে প্রতি দশজনের মধ্যে যদি একজনকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি জীবনে কয়টি বই পড়েছেন, তখন অধিকাংশ উত্তর হয় হতাশাজনক। এমনও হাজারো মানুুষ আছে, যারা জীবনে একটি বইও পড়েননি। বইয়ের ধারেকাছেও যাওয়া হয়নি। ফলে আমরা জাতি হিসেবে জ্ঞান-গরিমায় বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়লাম। আমাদের জ্ঞান চোখ। একটি বই একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যায় জ্ঞানের অনন্য উচ্চতায়। জ্ঞানী ব্যক্তির কদর যুগে যুগে বাড়ে বৈ কমে না। জ্ঞানের বাহন বই ছাড়া মানবজাতির কল্যাণ ও উন্নতি আর কোথাও নিহিত নেই। এই বিষয়গুলো আমরা উপলদ্ধি করতে পারিনা। আমরা সবাই কেবল সস্পদের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। জ্ঞানের উৎকর্ষতার কাছে সম্পদ কিছুই নয়। সম্পদ মানুষকে সভ্য করে তুলতে পারে না, কিন্তু জ্ঞান মানুষকে সভ্যতার উচ্চ আসনে নিয়ে যায়। আর সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে হলে বইয়ের ধারস্থ হতে হবে। বইয়ের সান্নিধ্যে না আসলে সে অর্জন কখনো সম্ভব নয়।
কোনো কোনো জ্ঞানীরা বলেছেন, জীবনে একজন মানুষের ১০ হাজার বই পড়া উচিৎ। নেপোলিয়ন বলেছেন, অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। কিন্তু আমি আর আপনি জীবনে কত হাজার বই পড়েছি? অথবা আমরা কত হাজার বইয়ের সাথে সঙ্গ দিয়েছি? এটার উত্তর আমাদের কাছে বড়ো হতাশাজনক। কারণ আমরা বই বিপ্লবকে ইউরোপিয়ানদের মতো কাজে লাগাতে পারিনি। আজকের দিনেও পশ্চিমারা যেভাবে বইপাঠে এগিয়ে, সেদিক থেকে আমরা এখনো পিছিয়ে। সম্প্রতি ডেইল মেইল ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচাইতে বেশি বই পড়েছেন এমন একজন নারীর স্টোরি প্রকাশ করেছেন। তার নাম লুইজ ব্রাউন। ৯১ বছর বয়সী নারী লুইজ ব্রাউনের একটি তথ্য প্রকাশ করেছেন। পত্রিকাটির তথ্যমতে, লুইজ ব্রাউন ২৫ হাজার বই পড়ে শেষ করেছেন। বলা হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে পাঠের মধ্যে তার চেয়ে বেশি বই পড়েছেন এমন দ্বিতীয় কাউকে খোঁজে পাওয়া যায়নি। আন্দাজ করুন তো! এক হাজার নয়, দুই হাজার নয়, পুরো ২৫ হাজার বই পড়েছেন এই নারী। তা-ও কেবল গ্রন্থাগার থেকে নিয়েই। আর এর বাইরে কতগুলো বই পড়া হয়েছে তার? সেটা জানা নেই ঠিক। শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৪৬ সালে। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ডজনখানিক করে বই পড়ে শেষ করেছেন লুইজ। আর কখনো তার বইগুলো ফিরিয়ে দিতে একটুও দেরি হয়নি। ঠিক সময় আর নিয়ম মেনেই বইপাঠ শেষ করেছেন এই নারী। লুইজ ব্রাউন আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে, পাঠে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য আমরা তার কৃতিত্বকে গ্রহণ করে বইপাঠে উদ্বুদ্ধ হতে পারি।
আজকের দিনে আমরা তরুণদের কাছে একটি বার্তা পৌঁছাতে পারি, তা হলো: বই মানুষের মনের ভেতরে জ্ঞানের আলো এনে অন্ধকার দূর করে দেয়। চেতনার আলোকে সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে নতুনত্ব দেখায়। বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ, নিকট থেকে দূরে, প্রান্ত থেকে অন্তে এমনকি যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞানের আলোকে পৌঁছে দেয়। বইয়ের কোনো বিকল্প নাই, জীবন পরিশুদ্ধির জন্য পাঠের কোনো বিকল্প নাই। ইউরোপীয়নরা যেভাবে বই বিপ্লবকে গ্রহণ করে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের ধারা অব্যাহত রেখেছেন, আমরাও যদি পাঠের মাধ্যমে বই বিপ্লব ঘটাতে পারি, তাহলে একদিন আমরাও সেরাদের সেরা হতে পারব। এটা অর্জনের পূর্বশর্ত হলো বইপাঠে মনোযোগী হওয়া। এই বিষয়টির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও পাঠাগার কর্মী