পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন রসায়নে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক?

বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সবসময়ই একটা সংবেদনশীল বিষয় ছিল। ১৯৭১ সালের ইতিহাস বিবেচনায় এ নিয়ে আলোচনা, রাজনীতি কম হয়নি। তবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে আওয়ামী লীগ আমলে, বিশেষত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রেক্ষাপটে।

তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নানা পরিবর্তনের মতো এখানেও কিছুটা ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। আভাস পাওয়া যাচ্ছে সম্পর্কের নতুন রসায়নের। এখন কি বাংলাদেশের কূটনীতিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসবে? পাকিস্তানের তরফ থেকে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ কতটা? সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশেরই বা লাভ কী? অথবা সমস্যার জায়গাগুলো কী?

সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেক দেশের মতো শুভেচ্ছা জানিয়েছে পাকিস্তানও। এছাড়া বাংলাদেশে পাকিস্তানের দূতাবাসেরও বেশ তৎপরতা দেখা গেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার দেখা করেছেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে। দেখা করেছেন বিএনপির নেতাদের সঙ্গেও। একই সঙ্গে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ফি বাদ দিয়েছে পাকিস্তান। সরাসরি ফ্লাইট চালু করার আগ্রহ দেখিয়েছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সাবেক কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করেছেন বলেও জানা যাচ্ছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনায় আরও নিবিড় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে আগ্রহ জানানো হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে পোস্ট দিয়েছেন শেহবাজ শরীফ।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বেলুচ বিবিসি বাংলাকে জানান, বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তান সবসময়ই একটা শ্রদ্ধাশীল, ইতিবাচক ও গঠনমূলক অবস্থানের আগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে।

তিনি বলছেন, মাঝে মাঝে সমস্যা হয়েছে, কিন্তু যখন সেসব সমস্যা অতিক্রম করার ইচ্ছা এবং সামনে এগিয়ে যেতে সম্পর্কের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করার ইচ্ছা থাকে, তখন দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে সামনে এগিয়ে যেতে আমরা সমস্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো।

সম্পর্কে আগ্রহ যে ছিল সেটা পাকিস্তানের হাইকমিশনের ফেসবুক পাতার পুরানো পোস্ট দেখে বুঝা যায়। বিগত বছরগুলোতে আগস্ট মাসে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের জন্য পাকিস্তানি আম উপহার হিসেবে পাঠানোর পোস্ট দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা ও সৌহার্দ্যের আহবান, এমন নানা পোস্টও দেখা গেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ৩০ আগস্ট ক্যামেরুনে ওআইসির সম্মেলনের ফাঁকে কথা বলেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব। বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনারও দেখা করেছেন সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ।

এ সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, গত কয়েক বছর ধরে তো পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক একটু শীতল যাচ্ছিলো, পাকিস্তান সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।

বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত মুখ, লেখক ফাহাম আবদুস সালাম মনে করেন গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের সরকার ভারতের চোখে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করেছে এবং ১৯৭১ সালকে ঘিরে বিভাজনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে, যেটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।

তিনি বলছেন, ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে অনেক পুরানো একটা সম্প্রীতির জায়গা ছিল, আধুনিক সময়ে এসে সেটা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের পেছনে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমকে ঘৃণার সংস্কৃতি প্রচারের জন্য দায়ী করেন তিনি।

শেখ হাসিনার পতনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘিরে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে উদ্বেগ উঠে আসতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ কি পরবর্তী আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে পরিণত হবে কি না এমন আলোচনাও উঠেছে।

ক্ষমা প্রসঙ্গ

বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই একটি আলোচিত বিষয় ছিল ১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ক্ষমা চাওয়া বা স্বীকৃতি। এ নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একাধিকবার কথা বললেও আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা করা হয়নি।

তবে এখন কি সেই ক্ষমা চাওয়া বা স্বীকৃতি দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না সে প্রসঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বেলুচ মনে করেন, ১৯৭১ সালের ‘বেদনাদায়ক’ ইতিহাস দুই দেশই বহন করে আসছে, কিন্তু সে সমস্যার সমাধান ১৯৭৪ সালেই দুই দেশের নেতারা করেছেন এবং চুক্তিও হয়েছে।

১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল (২০ ডিসেম্বর ১৯৭১)। ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি ৭০ এর নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের জয় নিয়ে টানাপড়েনে ক্ষমতা হস্তান্তর স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। তবে ১৯৭১ সালের তিক্ততা পেছনে ফেলে আন্তর্জাতিক মহলের চেষ্টায় ১৯৭৪ সালে দুই দেশের নেতাই অপর দেশে সফর করেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ এ পাকিস্তানের লাহোরে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে, তোপধ্বনি এবং গার্ড অফ অনার দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর আগের দিনই বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল পাকিস্তান। সে বছর জুন মাসে ভুট্টোও এসেছিলেন বাংলাদেশে।

ঢাকায় এসে ভুট্টো বলেছিলেন, যা হয়েছে তা নিয়ে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে বা তওবা করতে দেরি হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।

১৯৭৪ এর এপ্রিলের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিবরণেও রয়েছে যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।

শেখ মুজিবুর রহমানের তরফ থেকেও অতীত ভুলে নতুন সূচনা করার এবং ক্ষমার নিদর্শন হিসেবে বিচার না চালানোর সিদ্ধান্তের কথার উল্লেখ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি আর্কাইভ প্রতিবেদনে।

দুই নেতার সেসময়কার দূরদর্শিতা উন্নতি এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছে বলে উল্লেখ করেন মুমতাজ জাহরা বেলুচ।

পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্ম সেই ট্র্যাজেডির পরে জন্ম নিয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বিশাল শ্রদ্ধা রাখে। ৫০-৬০ বছর পর এসে সে প্রসঙ্গ আবার সামনে আনার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন এই কূটনীতিক।

২০০২ সালে তৎকালীন সেনা সমর্থিত প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফও ঢাকা সফরে এসে অনুশোচনা প্রকাশ করেন। তবে সেসব দুঃখ প্রকাশকে আনুষ্ঠানিকভাবে বা যেভাবে চাওয়া হয়েছিল তেমনভাবে ক্ষমা চাওয়া হিসেবে দেখা হয়নি বাংলাদেশে।

ক্ষমার বিষয়টিতে জোর দেওয়া বা এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে লজ্জা দেওয়ার মতো কঠিন মনোভাবের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীরও।

তবে পাকিস্তান এবং ভারতে ১৯৭১ কে ভারতের কাছে পরাজয় হিসেবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেটা বাংলাদেশের ‘মুক্তির আন্দোলনের’ সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এই জায়গায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐক্যমত্যে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন আসিফ মুনীর।

তিনি বলছেন, অবশ্য পাকিস্তানের মানুষ ৭১ সম্পর্কে ভিন্নভাবে জানলেও তাদের মধ্যে দুঃখবোধ ছিল না তেমনটাও নয়। একাত্তরের সময়েও পাকিস্তানি শিল্পী সাহিত্যিকরা কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করেছিল।

ফাহাম আবদুস সালামও ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানে নিজের একটি অভিজ্ঞতার গল্প জানান। সেখানে একজন ট্যাক্সিচালক যখন জানান, সালাম বাংলাদেশি তখন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তার কাছে ক্ষমা চান। সে তার হাত ধরে মাফ চেয়েছে ১৯৭১ সালের জন্য। এটা তার হৃদয়কে স্পর্শ করে। যদিও তিনি মানেন যে, পাকিস্তানের সবার মনোভাব একই রকম না; কিন্তু একরকম খারাপ লাগার বোধ সেখানে আছে।

আবদুস সালাম মনে করেন, যে ছেলেটার জন্ম ১৯৭১, ৭২ বা এর পরে সে কি দায়ী? আপনি কি আপনার দাদার অপরাধের জন্য দায়ী হবেন? ১৯৭১ সালের পাকিস্তান ও এখনকার পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এক নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশিদের ‘বড়ত্বের’ জায়গা দিয়ে বিবেচনা করার দরকার।

সম্পর্কের কী সুবিধা

বাংলাদেশের ঠিক প্রতিবেশী রাষ্ট্র না হলেও বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাণিজ্যিক সম্পর্ক একটা বড় দিক। অবশ্য আওয়ামী লীগ আমলেও বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ ছিল না।

বাংলাদেশে চামড়া, টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতে পাকিস্তানিদের বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তান বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আমদানি তালিকায় রয়েছে তুলা, কাপড়, বিভিন্ন রাসায়নিক, খনিজ ও ধাতব উপাদান, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সিনথেটিক ফাইবার, টেক্সটাইল সামগ্রী, কিছু চিকিৎসায় ব্যবহার্য সামগ্রী, এমন বেশ কিছু জিনিস রপ্তানি হয় পাকিস্তানে।

পাকিস্তানের সরকারি তথ্যমতে ২০২৩ সালেও বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে ৬ কোটি ৩৩ লক্ষ ডলারের বেশি পণ্য, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৬৫ কোটি ৫ লক্ষ ডলারের উপরে পণ্য। ২০১৯ এও ৮৩ কোটি ডলারের উপরে আমদানি হয়েছে পাকিস্তান থেকে।

এ থেকে এটাও বোঝা যায় যে একটা বড় বাণিজ্য ঘাটতির জায়গা রয়েছে যেখানে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতাই বেশি। অবশ্য সেটাকে সমস্যা বলে মনে করেন না পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।

এই উপদেষ্টা মনে করেন, ভারত বা চীনের ক্ষেত্রেও বড় আমদানি নির্ভরতা রয়েছে, আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে রপ্তানি হয় অনেক বেশি। সেগুলো অর্থনীতি বা ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক।

তৌহিদ হোসেন বলেন, ধরুন আমরা পাকিস্তান থেকে যদি প্রচুর পরিমাণে তুলা কিনি, পাকিস্তানের তো বাড়তি আসবে, কিন্তু আমাদের সেই তুলা দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে কাপড় রপ্তানি করি সেজন্য। এগুলো আসলে সম্পর্কযুক্ত।

পাকিস্তানেও বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার জায়গা রয়েছে, উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড ‘ইয়েলো’র কিছু আউটলেট থাকার উদাহরণ টানেন ফাহাম আবদুস সালাম। ব্যবসার দিকটা আমরা যথেষ্ট এক্সপ্লোর করিনি। পাকিস্তানে কিন্তু ২০ লক্ষের বেশি বাংলাদেশি থাকেন, সেই বাজারটাকেও আমাদের কাজে লাগানো উচিৎ বলেন তিনি।

সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে, বাণিজ্য বাড়লে আরও নতুন ধরনের সম্ভাবনার জায়গা তৈরি হবে বলে মত তার।

দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে থাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক সম্প্রতি জোরদার করার কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

পাকিস্তানও বাণিজ্যিক দিকটি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান মুমতাজ জাহরা বেলুচ। তিনি বলেন, বাণিজ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক এবং দুই দেশের মানুষের মাঝে সম্পর্কও ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে। একইসঙ্গে সার্ক এবং ওআইসির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হিসেবে দুই দেশ একত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

মুনির চৌধুরির ছেলে আসিফ মুনীরও মনে করেন দুই দেশের মধ্যে ধর্মের বাইরে সামাজিক সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। পাকিস্তানের সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র বা পোশাকের কদর রয়েছে বাংলাদেশে।

তার ভাষ্য, কিন্তু সেখানকার দরিদ্র বাঙালিদের দেখে পাকিস্তানিদের মধ্যে বাংলাদেশিদের কিছুটা খাটো করে দেখার প্রবণতা তিনি নিজেও পাকিস্তানে গিয়ে লক্ষ্য করার কথা জানান। সেটার পরিবর্তন আনার এবং বাংলাদেশের উদারপন্থী দিকগুলো তুলে ধরার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন আসিফ।

অবশ্য ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তরুণদের উদ্বুদ্ধ হতে দেখা গেছে যেসব ভিডিও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভালো লাগার জায়গা তৈরি করেছে।

মুখপাত্র বেলুচ জানান, দুই দেশের মানুষ, মূলত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটা বড় সৌহার্দ্যের জায়গা রয়েছে যার উপর ভিত্তি করে পারস্পরিক একটা লাভজনক সম্পর্কের সম্পর্কের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে।

ভ্রমণ এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে ইতিবাচক দিক রয়েছে বাংলাদেশেও। আমরা আমাদের স্বার্থে পাকিস্তানের সঙ্গে যেটুকু সম্ভব সম্পর্ক এগোতে চাই।

তিনি বলেন, আমাদের কতগুলো ইস্যুও আছে যেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা বন্ধ হয়ে ছিল। দেখা যাক সেগুলো কতটুকু কী করা যায়, আমরা দেখবো আগামী দিনগুলোতে যে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যেখানে পাকিস্তান তাদের স্বার্থ দেখবে, আমরা আমাদের স্বার্থ দেখবো।

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের শিক্ষার্থী পড়তে আসেন। আবার পাকিস্তানের এমন জায়গা রয়েছে যেসব জায়গায় যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও আগ্রহ রয়েছে।

তবে পাকিস্তানে যাওয়ার ক্ষেত্রে দূরত্বের পাশাপাশি একটি বড় অস্বস্তির জায়গা ভারত। যেহেতু বাংলাদেশের তিন দিক দিয়েই ভারত, ফলে বাংলাদেশের মানুষের কম খরচে যাতায়াত বা চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা-যাওয়া বেশি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই বিষয় খাটে। কিন্তু ভারত পার হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত গেলেও এমন অস্বস্তির জায়গাও থাকে যে একবার পাকিস্তানের ভিসা করা হলে পরবর্তীতে ভারত যেতে গেলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

সেই সমস্যা সমাধানের বিষয়ে খুব একটা আশাবাদী নন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতময় সম্পর্কের কারণে এ অঞ্চলের অনেক কিছু জিম্মি হয়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি উদাহরণ দেন- “সার্ক যে এগুতে পারেনি তার একটা মূল কারণ ভারত পাকিস্তান সম্পর্ক। ফলে বাংলাদেশের সুবিধার্থে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার সমাধান করে ত্রিপক্ষীয় কোনো সমঝোতায় যাবে বলে মনে করেন না পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।

তার ভাষ্য, যে মনে করবে যে পাকিস্তানে গেলে তার ভারতে যাওয়া অসুবিধা হবে, ভারতে যাওয়া বেশি প্রয়োজন, সে যাবে না।

এশিয়ার এ অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে বড় দ্বন্দ্বের জায়গা রয়েছে পাকিস্তান এবং চীনের। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হয়নি ভারতকে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিন্ন মাত্রা যেমনটা প্রকাশ পাচ্ছে তাতে এখন সেই ভাবনার জায়গাটা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে একটি সংগঠন। যদিও ভৌগলিক প্রতিবেশীর বাস্তবতায় ভারতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা বাংলাদেশের জন্যও কঠিন।

ভবিষ্যতে এ সম্পর্ক কেমন দাঁড়ায় সেটা আঞ্চলিক কূটনীতির ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে।