আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাতে থেকে সরকার ঋণ নেবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। যা সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৬ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বেশি। আর মূল বাজেট থেকে ২৬ হাজার ৬১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) যা ছিল ৭৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী (১ জুন) জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বছরজুড়েই রাজস্ব আদায়ে ধীর গতি বিরাজমান। জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমে গেছে। ফলে সরকার ব্যয় নির্বাহ করতে সরকারের ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হয়েছে। বেড়ে গেছে ঋণ। সে ধারাবাহিকতায় আগামী বছরেও ব্যাংক বাড়িয়ে লক্ষ্য ঠিক করেছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি পূরণ করতেই দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হয়। দেশের মধ্যে ব্যাংক–ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্রই ঋণের হচ্ছে প্রধান উৎস। আর বিদেশ থেকে ঋণের ক্ষেত্রে উৎস হচ্ছে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। আগামী অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে সরকার ১ লাখ ২০০০ কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার চিন্তা করছে, চলতি অর্থবছরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
প্রতিবারই অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের ব্যাংকঋণ নেওয়া বাড়ে। বিশেষ করে জুন মাসে। চলতি অর্থবছরেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে সূত্রগুলো জানায়। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। আগের অর্থবছরে ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১৩ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। একই সময়ে চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৩৯ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ মে পর্যন্ত ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৭৮ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে ৬৭ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। দেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণ বাড়লেও কমে গেছে বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে বিদেশি ঋণ পাওয়া গেছে ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৮ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, সাধারণত ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত একটি অর্থবছর ধরা হয়। সরকারের আর্থিক আয়-ব্যয়ের হিসাব সংবলিত এই বাজেটে থাকে অনেক হিসাব নিকাশ। সে হিসেবে আগামী ১ জুন ২০২২-২০২৩ অর্থবছর শেষ হবে। বাজেট এলেই মানুষের মনে ধারণা জন্মে, এবার নতুন করে কোন জিনিসের দাম বাড়বে? আর কোনটারই বা কমবে? বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাংলাদেশকেও মাশুল দিতে হচ্ছে। বাজেটের আগে একশ্রেণির ব্যবসায়ী নানা অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরাই হবে নতুন বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। তার ওপর এবারের বাজেট আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান শাসনামলের শেষ বাজেট। বলা যেতে পারে ‘নির্বাচনী বাজেট।’ নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। এর মাঝেও একটি গণমূখী বাজেট প্রণয়ন খুবই কঠিন কাজ।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে যা অনন্য রেকর্ড। গত ২০১৯ সালের ১৩ জুন বৃহস্পতিবার ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের জন্য প্রথম বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী ১ জুন তিনি যে বাজেট উপস্থাপন করবেন সেটি হবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের টানা ১৫ তম বাজেট। আর দেশের ইতিহাসে ৫২তম বাজেট।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরের প্রথম বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। আর প্রথম বাজেট পেশ করা হয় ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। ১৯৭১ সালের নয় মাসের রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এরপর দেশে ১০ জন অর্থমন্ত্রী ৫১টি বাজেট দিয়েছেন, এবার নিয়ে জাতি ৫২টি বাজেট পেতে যাচ্ছে।
১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ জাতীয় সংসদে প্রথমটিসহ মোট ৩টি বাজেট ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক সরকার এবং তাদের ছত্রছায়ায় বেশ কয়েকটি সরকার দেশ শাসন করেছে। এ সময় দেশে জাতীয় সংসদ সচল ছিল না। সামরিক সরকারগুলো অধ্যাদেশ আকারে বাজেট পেশ করে। সরকারি তথ্য থেকে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে নির্বাচিত সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাতের পর ১৯৭৫-১৯৭৬ অর্থবছর ড. আজিজুর রহমান অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট ঘোষণা করেন। এরপর সামরিক শাসক মেজর জেনারেল পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজে নিজে দেশের সর্বস্ব সেজে ২টি এবং তিনি প্রহসনের হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আরও একবারসহ মোট ৩টি বাজেট ঘোষণা করেন। ড.এমএন হুদা একবার, এরপর ১৯৮০-১৯৮১ ও ১৯৮১-১৯৮২ অর্থবছর পরপর দু’বার সাইফুর রহমান বাজেট ঘোষণা করেন।
জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে ১৯৮২ সালে আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-১৯৮৩ ও ১৯৮৩-১৯৮৪ দুই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন। ১৯৮৪-১৯৮৫ অর্থবছর থেকে ১৯৮৭-১৯৮৮ অর্থবছর পর্যন্ত পরপর ৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন এম.সায়েদুজ্জামান। ১৯৮৮-১৯৮৯ এবং ১৯৯০-১৯৯১ মেজর জেনারেল (অব.) মুনিম দু’বার। এর মাঝে ১৯৮৯-১৯৯০ ড. ওয়াহিদুল হক বাজেট পেশ করেন।
১৯৯১ সালে সামরিক শাসক এইচএম এরশাদকে স্বৈরাচার সরকার আখ্যায়িত করে পতন ঘটানোর পর তত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন হয়। ওই সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে এম. সাইফুর রহমান আবার অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ১৯৯১-১৯৯২ অর্থবছর থেকে ১৯৯৫-১৯৯৬ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৫টি বাজেট পেশ করেন।
মাগুরা নির্বাচন কেলেঙ্কারি বিরুদ্ধে গড়ে উঠা আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকারের পতনের পর তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নের্তৃত্বে সরকার গঠিত হয় এবং এসএএমএস কিবরিয়া অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৯৬-১৯৯৭ অর্থবছর থেকে ২০০১-২০০২ অর্থবছর পর্যন্ত টানা ৬টি বাজেট পেশ করেন।
২০০১ এর নির্বাচনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। এম সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে ২০০০-২০০১ অর্থবছর থেকে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর পর্যন্ত ৫টি বাজেট পেশ করেন। বিরোধীদলের আন্দোলনের মুখে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। সামরিক বাহিনী সমর্থনপুষ্ট ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়ে ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ২০০৭-২০০৮ ও ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা লাভ করলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান আবু মাল আবদুল মুহিত। তিনি ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে চলতি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর পর্যন্ত টানা ১০টি বাজেট পেশ করেন। এরপর ২০১৯-২০২০ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে আ হ ম মুস্তফা কামাল তার প্রথম বাজেট পেশ করেন। এবার নিয়ে তিনি তার পঞ্চম বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন।