নভেম্বরের প্রথমার্থে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে চাইছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলে ‘সংঘাতে’র রাজনীতি গড়াবে ভোটের মাঠে। যদিও কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন, সব দলের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলে সংঘাতের রাজনীতি পাবে নতুন মাত্রা।
দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একটি নতুন ধরনের মেরুকরণের কথা বলছে। সমমনা দলগুলো দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব আগেভাগেই দিয়ে রেখেছে বিএনপি। বিএনপির কড়া চোখ জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশের দিকে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হলে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে জাপা বা জামায়াত যুক্ত হলে ভোটের হিসাব অন্যরকম হবে বলে বিশ্বাস অনেকেরই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করে জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়েছিল। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের হিসাব আলাদা। তার আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল, জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। আবার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াত আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। জাতীয় পার্টিও আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল।
মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। বিপরীতে সংসদের প্রধান দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ঘোষণা করেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবেই লড়াই করবে তারা। ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে জাপা। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে দলটি ৫২টি আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্তও করেছে। নিবন্ধন না থাকলেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধিত কোনো দলের সওয়ার হয়ে অংশ নিতে চায় নির্বাচনে। এক সময়ের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা সদ্যপ্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা গঠিত ‘তৃণমূল বিএনপি’ও সম্প্রতি রাজনীতির মাঠে নেমেছে পাকাপাকিভাবে। এরই মধ্যে আলোচিত দুই সাবেক বিএনপি নেতা শমসের মোবিন চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার তৃণমূল বিএনপির হয়ে নেমেছেন ভোটের মাঠে। দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে নানাভাবে ‘বঞ্চিত’ বিএনপি নেতাদের দলে ভেড়াতে কাজ করছেন বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এমন অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল হতে চলেছে ‘ট্রামকার্ড’?
বিশ্লেষকরা বলছেন, নাটকীয়ভাবে যদি বিএনপি দ্বাদশ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেয় তাহলে দর-কষাকষির ফেঅকাস পয়েন্টে চলে আসবে সংসদের প্রধান দল জাতীয় পার্টি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চাইবে জাপাকে জোটে ভেড়াতে। এমন পরিস্থিতি হলে জাপা দর কষাকষিতে পেতে পারে বিশেষ সুবিধা। যদিও দলটির একাধিক নেতা দেশ বর্তমানকে বলেন, দর-কষাকষি করে কোনো জোট থেকেই খুব বেশি আসন বাগিয়ে নেয়ার সক্ষমতা বর্তামানে জাপার নেই। পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের অন্তর্কোন্দলে দলটি এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চাইতে দুর্বল। ওই নেতা বলেন, যদি জাপা দুই ভাগে বিভক্ত হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে জাপার ভোট ও আসনসংখ্যা আরও কমে যাবে। ভোট পাওয়ার দিক দিয়ে জনসমর্থনেও পিছিয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক মহলেও গুরুত্ব হারাবে। আর ‘ট্রামকার্ড’ হিসেবেও হয়তো জাপাকে বিবেচনা করবে না বড় দুই দল।
জানা যায়, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাপাকে ‘ট্রাম কার্ড’ বলা হতো। তার মৃত্যুর পর ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে জাতীয় পার্টি। গুরুত্বও কমে গেছে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে।
এরশাদের নেতৃত্বে আমলে কূটনৈতিক মহলে সবসময় জাপা আলোচনায় থাকত। এখন আর তা নেই। এখন জাতীয় পার্টিকে বলা হয় ‘আমাকে ব্যবহার করুন’ (ডাস্টবিন)। দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকেও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল করা হয়। তবে রুটিন ওয়ার্ক এবং জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসেবে ঢাকার বিদেশি হাইকমিশনে এখনও ডাক পান জাতীয় পার্টির নেতারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপার বর্তমান কর্মকাণ্ডে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এবং সম্ভাব্য প্রার্থীরাও হতাশ।
সূত্র মতে, জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করেছিল ১৯৯১ সালে। এরপর থেকে সব নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিয়েছে। বর্তমানে শুধু রংপুর বিভাগের মানুষ জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব আছে। অনেক মহানগর-জেলা-উপজেলায় জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব নেই। জোটগতভাবে নির্বাচনের ফলে ২৪৮টি আসনে জাতীয় পার্টির নির্বাচনি প্রতীক কি তাও হয়তো জানে না সাধারণ মানুষ। ওইসব আসনে সংগঠনের কার্যক্রমও তেমন নেই। এরপরও দলের মধ্যে ৫২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর একটি তালিকা তৈরি করেছেন জি এম কাদের। তাই দলটির নেতাদের দাবি জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রতিটি জেলার অন্তত একটি আসন ও বিভাগীয় শহরের দুইটি আসন নিশ্চিত করতে হবে। এতে দলটির জেলাভিত্তিক সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি ফিরে আসবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে হুসইেন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর, রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হতে পারেনি। দলীয় নেতাকর্মীরা ভেবেছিলেন দলটি রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকবে তো- এ সংশয় ছিল সবার মাঝে। তবে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে এককভাবে জাপা অংশ নিয়ে ৩৫টি আসনে জয়লাভ করে।
এরপর দলটির নেতাকর্মীরা চাঙা হতে থাকেন। ওই সময় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরী। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কাছে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব ছিল। গত ১৫ বছর ধরে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বেড়েছে ঠিকই। তবে পাশাপাশি দলটির ওপর থেকে বিশ্বাসও হারিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
তারা মনে করেন, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে, জাতীয় পার্টি যত ভোট পেয়েছিল সেটি পরে ক্রমাগত কমেছে। জাতীয় পার্টির ভোট বা সমর্থনগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দিকে চলে গেছে। তাদের মতে, আগামী নির্বাচনের পর জাপার জনসমর্থন আরও কমবে। তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন মত জাপা নেতাদের। তারা মনে করেন, বিএনপি যদি সমর্থনের দিক থেকে নিচের দিকে চলে যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় পার্টির সমর্থক সংখ্যা বা ভোটার সংখ্যা বাড়বে।
নাম প্রকাশে জাপার একজন অতিরিক্ত মহাসচিব দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এখন রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি লিমিটেড কোম্পানি। জি এম কাদের সাহেব এটির সিইও। আমরা যারা আছি সবাই এখানে এমপ্লয়ি। যে কোনো সময় আমাদের চাকরি চলে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, জি এম কাদের নিজের আত্মীয়-স্বজনকে দলে ঢোকাচ্ছেন এমপি বানানোর জন্য। যেমন আদেলুর রহমান আদেল এমপি, তিনি কোনোদিন রাজনীতি করেননি। অথচ দলীয় এমপি। আমরা কিন্তু দলের জন্য অনেক কিছু করেছি- কিন্তু কিছুই হইনি। সেহেতু জাপার অবস্থা আগামীতে খুবই শোচনীয় হবে। এটা স্বাভাবিক।’
জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টির আসন কমছে না বাড়ছে তা এখন বলা যাচ্ছে না। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি, নির্বাচনের জন্য প্রার্থী সেটআপ করছি। নির্বাচনের ৩ মাস আগে বলা যাবে আমাদের আসন বাড়বে না কমবে।
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ও প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইদুর রহমান টেপা বলেন, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হচ্ছে। জাপা আগের চেয়েও প্রার্থী সংখ্যা বাড়ছে। কারণ হিসেবে বলছে, একসময় খুলনা বিভাগে জাপার দলীয় প্রার্থী দেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সেখানে দলয় প্রার্থী দেয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম প্রত্যেকটি বিভাগে জাপার অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। সে হিসেবে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলে আসন সংখ্যা আগের তুলনায় বাড়বে। আর জোটগত নির্বাচনে অংশ নিলে সে ক্ষেত্রে দর কষাকষিতে যত আসন পাওয়া যায়।’
জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৪ আসনের জাপার এমপি আবু হোসেন বাবলা বলেণ, অনেকেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতায় নেয়ার মালিক দেশের জনগণ। জনগণ লাঙ্গলে ভোট দিয়ে বিপ্লব ঘটানোর জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। তাই বিদেশিদের হাতে নয়, বরাবরের মতো এবারও ক্ষমতায় যাওয়ার ট্রাম্প কার্ড হবে জাতীয় পার্টি।