রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় ‘১০০ শয্যা বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট স্থাপন’ প্রকল্পের কাজ ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর কার্যক্রম দুই ছরেও শুরু না হওয়ায় সচেতন মহলে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে জানা যায়, হিমালয়ের কাছাকাছি থাকা উত্তরাঞ্চলের শীতের প্রকোপ বেশি। তাই উত্তরের ৮ জেলার অস্বচ্ছল মানুষেরা শীত নিবারনে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। এতে জামা-কাপড়ে আগুন লেগে বেশিরভাগ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হন। এছাড়া উত্তরাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, গরম পানি, গরম তেল, বৈদ্যুতিক শট সার্কিট থেকে অগ্নিদুর্ঘটনায় শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যাওয়া রোগী ভর্তি হন রমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
১৪ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিটটি সারা বছরই রংপুর বিভাগের ৮ জেলার রোগী দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে। শীত এলে ৭০ থেকে ১০০ এর গন্ডি পেরিয়ে যায় রোগীর সংখ্যা। ফলে জায়গা সংকুলন না হওয়ায় সার্জারি বিভাগের বারান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয়। গুরুতরভাবে আঘাত পাওয়া রোগীদের শয্যার অভাবের কারণে আইসিইউ সুবিধা দিতে পারে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা ঢাকায় বার্ন ইউনিটে স্থানান্তরে করার পরামর্শ দিলেও রোগীকে ঢাকায় নিতে পারে না অসমর্থ রোগীর স্বজনরা। এতে করে রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। এছাড়া হাসপাতালের চতুর্থ তলায় সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া পোড়া রোগীদের ক্ষত স্থান পরিষ্কার করার জন্য প্রতিদিন হাসপাতালের নিচ তলায় বার্ন ইউনিটে আনা-নেওয়া করতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সবাইকে। অপরদিকে সংকটাপন্ন সামর্থ্যবান রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠালে সেখানে রোগীর চাপ বাড়ায় সেবা দিতে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়।
তাছাড়া দুর্ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টার ম্ধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিতে ব্যর্থ হলে তাদের ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর এক সভায় রংপুরসহ দেশের ৫টি জেলায় ‘১০০ শয্যা বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট স্থাপন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। রংপুরের এ বিশেষায়িত ইউনিটটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধীনে পরিচালিত হবে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ছাড়াও এ প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে সৌদি সরকার।
এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জানুয়ারী থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত । ৫ জেলায় এ ইউনিট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫৬ কোটি টাকা। ‘১০০ শয্যা বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট স্থাপন’ প্রকল্প শুরুর প্রায় দুই বছর শেষের পথে গেলেও রংপুরে এর কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজ দুই বছরেও শুরু না হওয়া চিকিৎসকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে রংপুরে পোড়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াসহ সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সচেতনরা।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. এমএ হামিদ পলাশ বলেন, সারাবছরই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী থাকে আমার ইউনিটে। বিশেষ করে শীতকালে রোগী কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফলে আমার ইউনিটের বাইরে সার্জারি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয়। এক ছাদের নিচে সব রোগী না থাকায় হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে গিয়ে চিকিৎসা দিতে নার্স, চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ১০০ শয্যার যে আলাদা বার্ন ইউনির হওয়ার কথা ছিল সেটির কোনো অগ্রগতি নেই। যদি ১০০ শয্যার সেই ইউনিটটি নির্মাণ হতো, তাহলে উত্তরাঞ্চলের পোড়া রোগীদের আরও আধুনিক ও দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া যেত।
রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের পরিচালক ডা. ইউনুস আলী বলেন, সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা পাস হয়েছে এবং সেটি গণপূর্ণ অধিদপ্তরের টেন্ডার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। শীত এলে যেহেতু এ হাসপাতালে রোগীদের অনেক চাপ থাকে, আমাদের অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকার ফলে আমরা তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারি না। সুতরাং ১০০ শয্যার বার্ন ইউনিট হলে দ্রুত আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ফলে উত্তরাঞ্চলের পোড়া কিংবা অগ্নিদগ্ধ রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তর রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খন্দকার বলেন, প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিদেশী প্রতিনিধি দল রংপুরে আসার কথা রয়েছে। তারা এসে সাইট পরিদর্শন করবেন। এরপর প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাকের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু বলেন, সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ ও মহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে কালক্ষেপন করে রংপুর বিভাগের মানুষকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রকল্প মেয়াদের মধ্যেই যেন এ বার্ন ইউনিটের অবকাঠামো নিমার্ণসহ ইউনিটটি চালু করা হয় এ দাবি জানাচ্ছি।