গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা চায়ের দোকানের আড্ডা- সব জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের বিদেশে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিষয়। একটি দৈনিক পত্রিকায় দেশের এমন ধনকুবের বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য নিয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষন চলছে।
তার মধ্যে কিছু আশঙ্কার কথা সবার মুখেই, আদৌ কি কিছু হবে এত বড় রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তির? সঠিকভাবে তদন্ত হবে? মানুষ কি সত্য-মিথ্যা জানতে পারবে? নাকি অন্য কোন ইস্যুতে চাপা পড়বে এই অপরাধের খবর।
তবে স্বস্তির বার্তা হচ্ছে- দুদক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এস আলমের সিঙ্গাপুরের যে বিনিয়োগের অর্থ এটা পাচার ছাড়া আর কিছুই না। বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং আইনে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাকে আইনের আওতায় আনা উচিত। ’
তবে তিনি বলেন, ‘এই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং এই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, দুদক ও সিআইডিসহ আরো আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু কে ব্যবস্থা নেবে? তারা তো সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ’
এস আলমের অর্থ পাচার প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তাতে পরিষ্কার যে সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগের অর্থ অনুমোদনহীন এবং মানি লন্ডারিং। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওই পরিমাণ অর্থ তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই নিয়েছেন। আর ওই অর্থের উৎস যদি তার বিদেশে কোনো ব্যবসা থেকে হয় তাও জানাতে হবে। তার কোনোটিই তিনি করেননি। ’
তিনি আরও, ‘বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে এটা এই প্রথম নয়। অনেক দিন ধরেই এখান থেকে দেশের বাইরে অর্থ পাচার হচ্ছে। আর সেটা দিন দিন বাড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনা। এর একটি কারণ হতে পারে পাচার রোধ ও পাচারের পর যাদের ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব তারা হয়তো অদক্ষ। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যারা অর্থ পাচার করেন তারা প্রভাবশালী। টাকা ছাড়াও তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে। ফলে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। ’
শুক্রবার (৪ আগস্ট) পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে রোববার (৬ আগস্ট) সেটি আদালতে নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন। আদালত দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এই অর্থ পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন।
এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ সাংবাদিকদের বলেন, দুদক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্ত পরিচালনা করে দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্টে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এস আলম গ্রুপের মালিকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযুক্ত কর্মকাণ্ড ঠেকাতে তাদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
যা আছে সংবাদেঃ
সংবাদে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। দেশের বাইরে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতির দরকার হয়। তবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য এ পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিলেও সেই তালিকায় চট্টগ্রামভিত্তিক বিশাল এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম নেই।
কাগজপত্রে আরও দেখা যায়, গত এক দশকে সিঙ্গাপুরে এস আলম অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং অন্যান্য যে সম্পদ কিনেছেন সেখানেও বিভিন্ন উপায়ে কাগজপত্র থেকে তার নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত দেশ থেকে ৪০ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশে বিনিয়োগের জন্য নেয়া হয়েছে। তবে এই পরিমাণ অর্থ ২০০৯ সালের পর সিঙ্গাপুরে এস আলমের কেবল দুটি হোটেল ও একটি বাণিজ্যিক স্পেস কেনা ৪১১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড এবং যে পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদণ্ড।