টেকসই শ্রমবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরী

শিল্প-কারখানায় শ্রমিকের মৃত্যু...

লেখক অমল বড়ুয়া

দেশের উন্নতি অগ্রগতি ও প্রগতির মূলে রয়েছে উৎপাদন।  আর এই উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে মানবিক মেধা, শ্রম ও দক্ষতা।  গৃহস্থলী থেকে কৃষি, পরিবহন থেকে ভারী শিল্প-কারখানার উৎপাদন সর্বক্ষেত্রে মানুষের ঘাম ও শ্রম নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।  আর এই পরিশ্রমী মানুষের শ্রমঘন উৎপাদনী শক্তিই জাতীয় উন্নতির মূল নিয়ামক।  শ্রমিকের ঘাম, শ্রম ও মেধার ফলশ্রুতিতে উর্বর ও ঋদ্ধ হচ্ছে জাতীয় আয়।  জাতীয় আয়ে অবদান রাখা শ্রমিকরা নানান প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে শিল্প-কারখানার চাকা সচল রাখলেও শ্রমবান্ধব কর্মপরিবেশের অভাবজনিত কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি মৃত্যুর মতো কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে হচ্ছে তাদের।  কারণ আমাদের শিল্পকলকারখনায় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি সবসময় উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাবমতে, ২০২০ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭২৯ জন শ্রমিক।  ২০১৯ সালে মারা যান ১ হাজার ২০০ জন।  আর ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ২ হাজার শ্রমিক।  ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মারা যায় ১১২ জন শ্রমিক।  ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে মারা যায় ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক। পঙ্গু হয়েছে আরো অনেকে। ২০১৬ সালে টঙ্গিতে টাম্পাকো প্যাকেজিং কারখানায় আগুনে প্রায় ৪০ জন শ্রমিক নিহত হয়। আমাদের দেশে অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে আইন আছে।  অগ্নি নির্বাপণ সংক্রান্ত লাইসেন্স (ধারা- ৪ ও ৮, অগ্নি নির্বাপন আইন); বিদ্যুৎ ব্যবহার সংক্রান্ত সার্টিফিকেট [বিধি- ৫৮ (৮), বিএলআর]। তবে তা যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে না।

জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।  এর মধ্যে এক হাজার তিনজন পুরুষ এবং ৫০ জন নারী শ্রমিক। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে পরিবহনখাতে; ৫১৩ জন।  দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণখাতে।  ৮৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষিখাতে।  এছাড়া খাদ্য-উৎপাদনকারী শিল্পে ৫৫ জন, দিনমজুর ৪৬ জন, মৎস্য-শ্রমিক ২৭ জন, নৌ-পরিবহনখাতে ২৪ জন, অভিবাসী শ্রমিক ১৮ জন, জাহাজভাঙা শিল্পে ১২ জন, বিদ্যুৎখাতে ১১ জন, তৈরি পোশাকশিল্পে চারজন এবং অন্যান্য খাতগুলোতে যেমন- স্টিল-মিল, মেকানিক, ইটভাটা, হকার, চাতালসহ ইত্যাদি সেক্টরে ১০২ জন শ্রমিক নিহত হন।

গত বছরে (২০২২) কর্মস্থলে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ৫০ জন, পরিবহন খাতে ৪৯ জন, নির্মাণখাতে ৩৫ জন, জাহাজ-ভাঙা কারখানায় ৭ জন, চা-খাতে ৮, পোশাক-কারখানায় ৮, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ১২ জন, কৃষক ১৩ এবং ৯ পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিহত হয়েছেন।  এ ছাড়া দিনমজুর, বিদ্যুৎকর্মী, কলকারখানা, গৃহপরিচারিকাসহ আরও ৪৬ জন নিহত হয়েছিলেন।

বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মস্থলে বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা ৭১২, যা ২০২১ সালে ছিল ৫৩৮ ও ২০২০ সালে ৪৩৩। এর মধ্যে ৪ জুন-২০২২ এ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণে ৫০ জন নিহত হওয়ার হিসাবও রয়েছে।  ৪ মার্চ ২০২৩-এ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের বিস্ফোরণের ঘটনায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২৪ জন।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৫০টিরও বেশি জাহাজ ভাঙা কারখানা রয়েছে।  এসব কারখানায় প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করে।  এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ১৮ বছরে সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় মোট ২৪৯ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম একটি আন্তর্জাতিক এনজিও জোট, যারা পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ জাহাজ রিসাইক্লিংয়ের প্রচারণা নিয়ে কাজ করে।  কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়।  পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টির প্রধান কাজ হলো কর্মক্ষেত্রে যেকোনও ধরনের ঝুঁকি বা সম্ভাব্য বিপদ প্রতিরোধ করা।  অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অনেক দেশে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার (Workplace/Occupational Health & Safety, সংক্ষেপে W/OHS) বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।  আর এজন্য প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট সকলকে অবধারিতভাবে তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন করা হয় এবং জরুরি অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।  এই বিষয়ে আমাদের দেশে রয়েছে যথাযথ আইন।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (বিএলএ) ও বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ (বিএলআর) অনুযায়ী পেশাগত স্বাস্থ্যা ও সেইফটি সংক্রান্ত বিধি বিধান প্রণীত হয়।  ২০১৩ সনে শ্রম আইন সংশোধন করে সেইফটি কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।  শ্রম আইন বাস্তবায়নের লক্ষে ২০১৫ সনে শ্রম বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্রম বিধিমালায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বা কারখানায় সেইফটি কমিটি গঠনের পদ্ধতি, দায়িত্ব কার্যপদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়াদি বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে।  বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ অনুযায়ী, কোন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৫০০ জন শ্রমিক নিয়োজিত থাকলে সে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ফায়ার অফিসার এবং এক বা একাধিক সার্বক্ষণিক কল্যাণ কর্মকর্তা থাকতে হবে [বিধি- ৫৫(১২) ও ৭৯]।

এটা আশা করা যায় যে, এ কর্মীগণ প্রতিষ্ঠানের পেশাগত স্বাস্থ্যা ও সেইফটি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়গুলোও নিশ্চিত করবে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি বিষয় উত্থাপন করে শ্রমিকরা যেন কোন প্রকার নেতিবাচক পরিণতির শিকার না হন সেজন্য ব্যবস্থাাপনা কর্তৃপক্ষ অবশ্যই তাদেরকে আশ্বস্ত করবেন [ধারা- ৮৬, বিএলএ; বিধি- ৭৯, এবং তফসিল-৪ (১), ৪ (১১), ও ৪ (১২), বিএলআর]।  বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯ (২০১৯ সনের ২ নং আইন) ৩৫(১) প্রত্যেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকের তাহার শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য মানসম্মত নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও স্বাভাবিক কর্ম পরিবেশ প্রদান ও উহার রক্ষণাবেক্ষণ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য।

এছাড়া খাবার পানি সংক্রান্ত সার্টিফিকেট [বিধি- ৫০ (৫), বিএলআর]; বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা [ধারা- ৭৯ গ, বিএলএ; বিধি৬৮ (৪) ও ৬৮ (৫), বিএলআর) বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা অনুসৃত হয় বলে প্রতীয়মান হয় না।  তাছাড়া বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯ (২০১৯ সনের ২ নং আইন) ৩৬(১) যে সকল প্রতিষ্ঠানে অন্যুন ২৫ (পঁচিশ) জন স্থায়ী শ্রমিক কর্মরত রহিয়াছেন, সেইখানে মালিক প্রচলিত বিমা আইন অনুযায়ী গ্রæপ বিমা চালু করিবেন।  শ্রম-আইন বলছে, কর্মস্থলে কোনো শ্রমিক মারা গেলে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপ‚রণ দিতে হবে।  এই ৫ লাখের মধ্যে ২ লাখ টাকা সরকার, ২ লাখ বিমা কোম্পানি এবং ১ লাখ টাকা কারখানা মালিকের দেয়ার কথা।  কিন্তু দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বিমা করে না।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, দেশে বড়, মাঝারি, ছোট, অতি ক্ষুদ্র সব মিলিয়ে কারখানা আছে ৪৬ হাজার ২৯১টি।  আর বিভিন্ন খাতে শ্রমিক ৯ কোটি ৬২ লাখ।  এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ১২ লাখ ও নারী ২ কোটি ৫০ লাখ।  এরা সবাই এখনো কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা শঙ্কার মাঝেও জীবিকার তাগিদে লড়ে যাচ্ছে। দেশের অগ্রগতির স্বার্থে অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।  তাছাড়া টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষাবিধি পালন, শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বাংলাদেশ শ্রম-বিধিমালার ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রকে শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও অনুকুল রাখার বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। উন্নত বিশ্বের অভিমুখে অভিযাত্রায় বাংলাদেশ রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে কাজ করেছে, আর এই অগ্রযাত্রার পাথেয় হিসেবে শ্রমজীবিদের পেশাগত সুরক্ষার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।  পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট