স্বাস্থ্যখাতের ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এছাড়া রংপুরসহ ঢাকায় তার ৭৩ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন। কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মশিউর রহমান এসব তথ্য জানিয়েছেন। তবে রংপুরের বিলাসবহুল বাড়িসহ ১২ স্থাপনা জব্দ করা হলেও নগরীর অভিজাত এলাকায় ১০ তলা আলিশান অট্টালিকা সেই তালিকায় নেই বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুদকের তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন বিদেশে পালিয়ে থাকার পর সম্প্রতি তিনি ঢাকায় আসেন। রংপুর নগরীতেও কিছু দিন অবস্থান করেন। তার দেশত্যাগ ঠেকাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। দুদক সূত্র জানায়, রংপুরে একসময় বখাটে হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জিরুল ইসলাম মিঠুর বাড়ি জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে। ধাপ এলাকায় মেডিকেলের পূর্ব গেট এলাকায় তার বাবার সূত্রে পাওয়া টিন শেডের আধাপাকা বাড়ি ছাড়া তার আর কোনো সম্পত্তি ছিল না। তবে প্রভাবশালী এক ব্যক্তির সহায়তায় তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের কাজ পান। ওই সময় তার ব্যবসায়িক সহযোগী ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের এক সদস্য। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে দেশজুড়েই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের ঠিকাদারি পেতে শুরু করেন। একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করতে থাকেন। তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় বড় কর্মকর্তারাও। অভিযোগ আছে, স্বাস্থ্য বিভাগে কোনো কর্মকর্তা যোগ দিলেই তার কাছে ৫-১০ কোটি টাকার উপহার চলে যেত। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এই খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা হেলিকপ্টারে তার সফরসঙ্গী হয়ে রংপুরে ভ্রমণ করতেন। দুদক সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উচ্চমূল্য দেখিয়ে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ, দরপত্র অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালামাল সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন, অপ্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহের পাশাপাশি বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছিলেন। মালামাল সরবরাহের নামে তিনি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, সিলেট আইএইচটি, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, ঢাকা ডেন্টাল হাসপাতাল সিএমএসডিসহ বিভিন্ন হাসপাতালের শত শত কোটি টাকা লুট করেন। দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, অনিয়মের মাধ্যমে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে অবৈধ সম্পদের মালিক হন। এছাড়া ঢাকা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মিঠুর ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ৭শ ৩৮ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। তদন্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে দেশে থাকা তার সম্পত্তি জব্দ ও বিদেশে থাকা অর্থ উদ্ধারে মানি লন্ডারিং আইনে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. আছাদুজ্জামানের আদালতে আবেদন করলে বিচারক ৭৩ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ ও দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেন।
জব্দ হচ্ছে যেসব সম্পত্তি
ঢাকার সম্পত্তি: আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, ঢাকার বনানী ভিওএইচএসের ৪/এ রোড ৪এ নম্বর বাড়ি, উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর সড়কে পাঁচ কাঠা জমিতে পাঁচ তলার ৪৬ নম্বর বাড়ি, উত্তরার পাঁচ নম্বর সেক্টরের সাত নম্বর সড়কে ৫.২৫ কাঠা জমিতে চার তলা বাড়ি, বনানীর সি ব্লকের ছয় নম্বর ব্লকের আট নম্বর সড়কে ছয় তলা বাড়ি, সুবাস্তু ফিরোজা ভিলার অ্যাপার্টমেন্ট, গুলশাল আবাসিক এলাকায় ৩৭২৫ বর্গফুট ফ্লাট ও দুইটি কার পাকিং, দক্ষিণ কল্যাণপুরে রিগাল হাইটসে ফ্লাট, সুবাস্তু নজরভ্যালি প্রজেক্ট ৩ নম্বর টাওয়ারে ১,৫৮৩ বর্গফুট ফ্লাট, প্রগতি সরণিতে অ্যাপার্টমেন্ট, উত্তরায় ৫৮৫ বর্গফুট ফ্লাট, ২৩-২৫ নম্বর প্লট, টঙ্গিতে তিন কাঠার দুইটি প্লট।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সম্পত্তি: রংপুরের বুড়িরহাট রোড ধাপ এলাকায় কয়েক কোটি টাকার বাড়ি, রংপুর সদরের কোবারু এলাকায় আট শতক জমি, চব্বিশ হাজারী এলাকায় ৭৫ শতক জমি, কোবারু এলাকায় ২৭.৫০ শতক জমি, বুড়িরহাট রোডে ৩ শতক জমি, নগরীর মন্থনা এলাকায় ১০ শতক জমি। নগরীর বুড়িরহাট এলাকায় বাড়ির মূল্য ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেখানো হলেও স্থানীয় বাজারমূল্য অনুযায়ী ২০ কোটি টাকার বাড়ি, নগরীর বিনোদপুর, দর্শনা, দেওডোবা এলাকায় ১৫ বিঘার উপরে বাড়ি করার উপযোগী জমি। এছাড়া রংপুর নগরীর অভিজাত এলাকায় ধাপে ১২ শতক জমির উপর ১০ তলা বিশিষ্ট বাড়ি। বাড়িটিতে কছির উদ্দিন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাইন বোর্ড থাকলেও সেখানে এখনও হাসপাতাল ও কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়নি। শুধু দুই তলা পর্যন্ত ডাক্তারদের চেম্বার রয়েছে। ধাপ এলাকায় সরকারি দর অনুযায়ী প্রতি শতক জমি ২৫ লাখ টাকা হলেও সেখানে প্রতি শতক জমি এক কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে ধাপ এলাকার কিছু বাসিন্দা জানান। তদন্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, আদালত যেসব সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছেন, সেগুলো সরকারি মূল্য অনুযায়ী দর নির্ধারণ করা হলেও এগুলোর বাজার দর অনেক বেশি। তিনি বলেন, “ভুলক্রমে ধাপ এলাকার ১০ তলা ভবন জব্দের আওতায় আসেনি। তবে দ্রুত এটি জব্দের জন্য আবেদন করা হবে।” এই কর্মকর্তা বলেন, “মিঠু দীর্ঘদিন বিদেশে পলাতক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দেশে আসেন বলে জেনেছি। তিনি যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন, সেজন্য আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারে বিভিন্ন সংস্থা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।”