জগদীশের চেয়ে ভাগ্য খারাপ শিবনারায়ণের

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর চেয়েও যেন শিবনারায়ণ দাসের ভাগ্য বেশি খারাপ। কারণ জগদীশ চন্দ্র বসু আর মার্কোনি একই সময়ে বেতার আবিষ্কার করেন। কিন্তু মার্কোনি আগে প্যাটেন্ট করানোর ফলে বেতার যন্ত্র আবিষ্কারের সুখ্যাতি জোটে তার কপালেই। বঞ্চিত হন স্যার জগদিশ চন্দ্র বসু। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশা নিজে করেও তার স্বীকৃতি পাননি তৎকালীন ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস। তার করা নকশা থেকে শুধু মানচিত্রটুকু বাদ দিয়ে নকশাকার হিসেবে স্বীকৃতি পান শিল্পী কামরুল হাসান। কামরুল হাসানকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রকৃত নকশাকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে শিবনারায়ণ দাসের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। কারণ, পতাকাটির আকার, অনুপাত কোনো কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি। শুধু মাত্র লাল বৃত্তের মাঝ থেকে মানচিত্রটি তুলে নেয়া হয়েছিল।

২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কলা ভবনের সামনে আয়োজিত ‘চতুর্থ জাতীয় পতাকা উৎসব-২০১৪’ এ উপস্থিত হয়েছিলেন শিবনারায়ণ দাস। তিনি যদি জানতেন ওই দিন সেখানে চতুর্থ জাতীয় পতাকা উৎসব করা হবে, আর স্মৃতিচারণ করতে বলা হবে, তাহলে তিনি সেই উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন না। সেদিন ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন সঞ্চালক নাজমুল হোসেন মিথ্যা বলেই নিয়ে এসেছিলেন। নাজমুল হোসেন পরে তাঁর একটি বক্তব্যে বলেন, ‘তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য গত পাঁচ বছর আমি বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে গিয়েছি, কিন্তু কিছুতেই তাঁর সাক্ষাৎকার পাইনি। আজ অনেকটা মিথ্যা বলেই ওঁনাকে এ অনুষ্ঠানে হাজির করাতে সক্ষম হয়েছি।’

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে সেদিন শিবনারায়ণ দাস তাঁর মনের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, ‘আপনারা চুপ করুন। কোনো স্তুতিবাক্য আমি পছন্দ করিনা। আপনাদের সত্য বলার সাহস নেই। সত্য বলার সৎসাহস হারিয়ে ফেলেছেন আপনারা। এখন এসেছেন স্তুতিবাক্য শোনাতে!’ বোঝা গেল শিব নারায়ণ দাশ দীর্ঘ ৪৪ বছর নিজের মনের মধ্যে কতটুকু কষ্ট, যন্ত্রণা ও ক্ষোভ জমে রেখেছেন। আত্মাভিমানি এ ব্যক্তিটি নিজের ক্ষোভের কথা কখনও কারও কাছে প্রকাশ করেননি। বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টটা সবসময় নিজের ভেতরই চেপে রেখেছিলেন। কখনও গণমাধ্যমের সামনেও দেখা যায়নি তাকে। বিভিন্ন সময়ে তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য গণমাধ্যম কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে তার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে রাজি হননি।

উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়, শিবনারায়ণ দাস বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রথম প্রকৃত নকশাকার। তিনি একজন স্বভাব আঁকিয়ে ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ৪০১ নম্বর (উত্তর) কক্ষে রাত এগারটার পর পুরো পতাকার নকশা সম্পন্ন করেন। এ পতাকাই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলিত হয়। ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী গঠন করা হয়। এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আসম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনলেন; এরপর প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল) এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অঃষধং নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) মানচিত্র। শিবনারায়ণ দাস পরিশেষে তার নিপুন হাতে মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে, এমনি করে রচিত হলো ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র পতাকা, যা কিছুদিন পর স্বীকৃত হয় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসেবে। ২৩ শে মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির ৩২ নং বাসায় শিবনারায়ণ দাসের আঁকা পতাকা উড়াতে দেখা গেছে। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, ক্রিকেট, ফুটবল খেলার মাঠে শিবনারায়ণ দাসের নকশাকৃত পতাকাই ওড়াতে দেখা যায়।
সেদিন পতাকার মাঝে মানচিত্র আঁকার কারণ ব্যাখ্যা করে শিবনারায়ণ দাস বলেন, ‘পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা আলাদা করে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বোঝাতে মানচিত্রটি দেওয়া হয়, যাতে করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়। কারণ আমাদের বাংলা বলতে বুঝিয়েছি আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডকে। পশ্চিম বঙ্গের ভূখণ্ড অন্য একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত নয়।
দেখুন, ভারতের মানচিত্রের মধ্যে ফাঁকা অংশে বাংলাদেশের মানচিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগেও ফাস্ট ওয়ার্ল্ডের অনেক মানুষ বাংলাদেশকে চিনতো ভারতের অংশ হিসেবে, যদি পতাকার মানচিত্রটি সরিয়ে দেয়া না হতো, তাহলে মানচিত্রের সুবাদেও বাংলাদেশকে যেকোনো মানুষ আলাদাভাবে চিনতে পারতো। আমাদের পতাকা জাপানের মতো, এমন কথাও একটু কম উচ্চারিত হতো, কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা জাপানের মতো এমন কথা কেউ বলে না।

শিবনারায়ণ দাসের শ্যালক অরুণ চৌধুরী তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তাকে দেখেছি তিনি সবসময় নিজের কাজে ডুবে থাকতেন। গবেষণা আর লেখালেখির মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন। ধর্ম নিয়ে কখনো বাড়াবাড়ি দেখিনি। খুব যে ধর্মীয় আচার মানতেন তাও না। তাই তিনি শরীর শশ্মানে দাহ করার সুযোগ রাখেননি। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চক্ষু দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর শরীরের বাদবাকি অংশ দান করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।’ এমন নিভৃতচারী মৃত্যুহীন মানুষটি বেঁচে থাকবেন বাঙালির অন্তরে। বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের অংশ হয়ে।

ঠিক একইভাবে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রকৃত নকশাকারও বঞ্চিত হয়েছেন। ভারতের জাতীয় পতাকার নকশাকার হিসেবে সর্বত্র যে নামটি পাওয়া যায় সেটি হলো পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। কিন্তু তিনি প্রকৃত নকশাকার না। ব্রিটিশ গবেষকের বইয়ে উঠে আসে এক মুসলিম নারীর নাম। সুরাইয়া বদরুদ্দিন তায়াবজি। সুরাইয়ার স্বামী ছিলেন বদরুদ্দিন ফাইজ তায়াবজি। তিনি একজন ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) অফিসার হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। সে সময়েই ভারতের জাতীয় পতাকার নকশা করেন তার স্ত্রী। এরপর নেহরুর কাছে পতাকাটি নিয়ে গেলে তিনি তা পছন্দ করেন এবং তার গাড়িতে লাগিয়ে নেন। এরপর এ পতাকাটিই গৃহীত হয় ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে। কিন্তু প্রকৃত হিসেবে অজ্ঞাত কারণে কখনই সুরাইয়ার নামটি ইতিহাসে তোলা হয়নি। সুরাইয়া তায়াবজির তৈরি করা জাতীয় পতাকাটি প্রথম গৃহীত হয় ১৭ জুলাই ১৯৪৭ সালে। ভারতীয় কোনো ইতিহাসবিদের লেখায় সুরাইয়ার তৈরি করা পতাকাটির বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ইংলিশ ইতিহাসবিদ ট্রেভোর রয়েলের বইতে সুরাইয়ার নাম পাওয়া যায়। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ভারতীয় জাতীয় পতাকাটির নকশাকার বদরুদ্দিন তায়াবজির স্ত্রী সুরাইয়া তায়াবজি। ব্রিটিশ এ ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ‘ভারতের ইতিহাসের মাঝে চলমান এ ধরনের বিতর্কের মাঝে আরেকটি হলো জাতীয় পতাকার ডিজাইন একজন মুসলমানের করা, বদর-উদ-দিন তায়াবজি। বাস্তবে তিন রঙের পতাকাতে ছিল একটি চরকা, যা গান্ধী তার পার্টির চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতেন। তায়াবজি মনে করেন এটি ভূল বিষয় উপস্থাপন করবে। এরপর বহু চাপের পর গান্ধী এ চাকাটি পতাকায় নিতে রাজি হন। কারণ সম্রাট অশোক হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের নিকটই সম্মানিত ছিলেন। পতাকাটি নেহরুর গাড়িতে উড়ে সেই রাতে, যা বিশেষভাবে তৈরি হয়েছিল তায়াবজির স্ত্রীর হাতে।’ ( Trevor Royle, The Last Days of the Raj, Cornet Books, Hodder and Stoughton, London)

লেখক : গনমাধ্যমকর্মী