নীতিমালা অনুযায়ী চিনিসহ বেশ কয়েকটি আমদানিকৃত ভোগ্যপণের দাম সরকার ট্যারিফ কমিশনের মাধ্যমে নির্ধারণ করে থাকে। এবার ঘটলো ব্যতিক্রম।ট্যারিফ কমিশনের দর বিশ্লেষণের আগেই চিনির দাম কেজিপ্রতি ২৫ টাকা বাড়িয়ে দিলেন মিল মালিকেরা।
মিল মালিকদের সংগঠন আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২২ জুন) থেকে চিনির নতুন মূল্য কার্যকরের ঘোষণা দিলেও আগেভাগে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে । নানা অজুহাতে মালিকেরা এ নিয়ে গত দশমাসে পাঁচবার চিনির দাম বাড়ালো কেজি প্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।
চিনির দাম বৃদ্ধির জন্য ঘুরেফিরে বলা হচ্ছে একই কথা। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর বৃদ্ধির পাশাপাশি ডলারের দাম ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিকে দুষছেন মালিকেরা। আমদানিকারকরা উচ্চ মূল্য এবং ডলার সংকটের কারণে বাড়তি দরে চিনি আমদানিতে এগিয়ে না আসায় বাজারে কমে গেছে সরবরাহ। যার কারণেই দামে প্রভাব পড়ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনির বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দর নিয়ন্ত্রণ করছেন মালিকেরা। সরকারের দ্বারস্থ হওয়ার আগেই তারা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
বছরজুড়ে চলছে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে প্যাকেটজাত ও খোলা চিনির উত্তাপ। সরকারের সাথে কোনো ধরণের আলোচনা ছাড়াই এই উত্তাপ আরো এক দফা বাড়িয়ে দেয়া হলো। চিনি মালিকদের সংগঠন-বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন
গত ১৯ জুন চিনির দাম বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি)চিঠি দেয়। আগামীকাল থেকে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১৫০ ও খোলা চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি করবে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করে দাম নির্ধারণ করে বাড়ানো-কমানোর ঘোষণা দিলেও এবার চিনি ব্যবসায়ীরা সরকারি সিদ্ধান্তের আগেই নতুন দাম কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন দর কার্যকরের দুই দিন আগে থেকে বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে চিনি।
প্রথা অনুযায়ী বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন চলতি মাসের শুরুতে চিনির দাম সমন্বয়ের জন্য সরকারকে চিঠি দেয়। নিয়ম অনুযায়ী, দরের বিষয়টি ট্যারিফ কমিশন পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে দাম নির্ধারণ করে। এরপর অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এবার ঘটলো ব্যতিক্রম।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়,সরকার এবার চিনি ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আমলে নেয়নি।সরকারের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে অ্যাসোসিয়েশন নিজেরাই নতুন দামের ঘোষণা দেয়। তারা বলেছেন, অর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য প্রস্তাবিত মূল্য ২২ জুন থেকে কার্যকর করা হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার প্রতি কেজি পরিশোধিত খোলা চিনির খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে ৮৪ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ৮৯ টাকা। পরের মাসে খোলা চিনি কেজি প্রতি ৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ৯৫ টাকা। নভেম্বরে খোলা চিনি ১০৭ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকা। নভেম্বর মাসের এ দাম কার্যকর হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
এবছরের ৬ এপ্রিল তিন টাকা কমিয়ে কেজি প্রতি ১০৪ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এ দাম কার্যকর হয় ৮ এপ্রিল থেকে। মূলত রমজানকে সামনে রেখে সরকার তিন টাকা কমালেও এক মাসের ব্যবধানে কেজি প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছে ১৬ টাকা। গত ১০ মে আবার ১৬ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু তাতেও নাখোশ ছিলেন চিনি ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ গত ১৯ জুন ২৫ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি ১৪০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ১৫০ টাকা। তবে প্যাকেটজাত চিনি নেই বাজারে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত চিনির দাম রমজানে চার টাকা কমিয়ে পাঁচদফা বাড়ানো হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দশ মাসে কেজি প্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ^বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও সরবরাহ কম থাকাসহ নানা ছুতায় ব্যবসায়ীরা আবার দর বাড়ানোর পথ খুঁজছিলেন। বিশ্ববাজার ও ডলারের দাম কিছুটা অস্থির থাকলেও এটিকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করে চিনির দাম একের পর এক বাড়ানো হচ্ছে।। তারা সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব কারখানায় উৎপাদনও কমিয়ে দিয়েছেন। এভাবে বাজারে তৈরি করা হচ্ছে সরবরাহ ঘাটতি।
চিনি আমদানি করতে বড় ধরণের বিনিয়োগ প্রয়োজন। বড় অর্থের বিনিয়োগ করতে দেশে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মুলত মেঘনা, এস আলম, সিটি, বসুন্ধরা ও টিকে গ্রুপ। এর বাইরে চিনি আমদানিকারক হিসেবে আবদুল মোনেম ও দেশবন্ধু সুগার লিমিটেড চিনি আমদানি করে থাকে। কয়েকটি গ্রুপের শীর্ষ পর্যায়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো ধরণের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগির আহমদ দেশ বর্তমানকে বলেন, খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে চাহিদার অর্ধেক পণ্যও আসছে না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সেই দাম তো মিল মালিকেরা মানছে না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তাহলে পাইকারি পর্যায়ে কিভাবে কম দামে পণ্য বিক্রি হবে।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ (ক্যাব), চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন দেশ বর্তমানকে বলেন, সরকার যে দাম বেঁধে দেয় সে দামে প্রকৃতপক্ষে পণ্য পাওয়া যায় না। নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যার প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। এটি অগ্রহণযোগ্য। সরকারকে বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে।
উল্লেখ্য,দেশে চিনির চাহিদা ২০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশে বেশিরভাগ চিনি আমদানি হয় ব্রাজিল ও ভারত থেকে।