চট্টগ্রামে পাল্টে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ভোটের হিসাব

জয় পেতে মরিয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্র্বাচনে চট্টগ্রামে পাল্টে যাচ্ছে ভোটের হিসাব। চট্টগ্রামের ১৬ আসনেই আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। ১৬ আসনের মধ্যে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, কোতোয়ালী-বাকলিয়া ও আনোয়ারা-কর্ণফুলী সংসদীয় আসন ছাড়া বাকী সব আসনে আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন দলের একাধিক নেতা। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া তিন হেভিওয়েট নেতা আপিল শুনানিতে মনোনয়ন ফিরে পাওয়ায় দলের ভোটারদের মধ্যে চলছে ভোটের নতুন হিসাব-নিকাশ। ফলে চট্টগ্রামের ১৬ আসনের বেশীরভাগ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বেশিভাগকেই দলের মনোনয়নবঞ্ছিত ‘বিদ্রোহী প্রার্থীর’ বিরুদ্ধে লড়তে হবে। জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাঁরা সংসদ সদস্য পদে জয়ী হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ফলে পাল্টে যাবে আগামী নির্বাচনে দলীয় ভোটারদের ভোটের হিসাব নিকাশ। নির্বাচন উৎসব মুখর ও অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু করতে দলের যে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বাধা নেই বলে জানান চট্টগ্রাম নগর এবং উত্তর-দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।

গত রোববার ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত আপিল শুনানির পর চট্টগ্রামের তিন জনের মনোনয়ন পত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। তাঁরা হলেন, চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনের মো. গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও নগরীর একাংশ) আসনের আবদুচ ছালাম এবং চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের এম এ মোতালেব। তাঁরা তিনজনই প্রার্থীতা ফিরে পেয়ে নির্বাচনে জয় নিয়ে শতভাগ আশাবাদ প্রকাশ করেন।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকায় কিছুটা স্বস্তিতে আছে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) এবং চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে। এই চার আসনে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। এছাড়া বাকী সব আসনে দলের স্বতন্ত্র খ্যাত বিদ্রোহীদের ভোটের মাঠে মোকাবেলা করে নির্বাচনে জয়ী হতে হবে।

তার মধ্যে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহাবুবুর রহমান রুহেল। এবার তাকে লড়তে হবে দলের মনোনয়ন-বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উত্তরজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের সাথে। একদিকে দলের প্রবীণ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে অন্যদিকে এলাকায় জনপ্রিয় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। এ আসনে জয়ী হতে দলের ভোটারদের কাছে কঠিন সমীকরণ পার করতে হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।

চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি আসনে বর্তমানে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য খাদিতাজুল আনোয়ারা সনি নৌকা প্রতীক পেয়েছেন। ওই আসনে আগে মহাজোটভুক্ত প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। তবে এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে অংশ নিচ্ছেন একই দলের এবং ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব। এছাড়া জোটের প্রার্থীরাও এই আসন ভোট করতে মরিয়া। ফলে এই আসনেও ভোটের হিসাব-নিকাশের সমীকরণ এখন জটিল আকার ধারণ করেছে।

চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে নৌকার মাঝি হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা। এবার তাঁর সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়বেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরী। ফলে বর্তমান সাংসদকে জিততে হলে ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে জিততে হবে।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বর্তমান সাংসদ দিদারুল আলমকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আল মামুনকে। এ আসনে বর্তমান সাংসদসহ স্বতন্ত্র ৪ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় এখন পর্যন্ত কিছুটা স্বস্তিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী।

চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে নৌকা পেয়েছেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম (এম এ সালাম)। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি এবারও জাতীয় পার্টির হয়ে ভোটের মাঠে আছেন। আবার, একই আসনে নতুন ভাগ বসানোর জন্য ফরম নিয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ফলে এই আসনে শেষ পর্যন্ত নৌকা থাকবে, নাকি শরীক দলের মধ্যে জাতীয় পার্টি বা কল্যাণ পার্টিকে ছাড় দেওয়া হবে সেটি স্পষ্ট নয়।

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদ। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন মনোনয়ন বঞ্চিত নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যাক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। একদিকে বর্তমান সাংসদ যেমন দলের কাছে পরিচ্ছন্ন নেতা হিসাবে জনপ্রিয়, অন্যদিকে মোহরার সন্তান ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান থাকাকালিন সময়ে এলাকায় নানা উন্নয়নমূলক কাজ করায় তাকে অগ্রাধিকার দেবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা। ফলে ভোটের হিসাবে নানা জটিলতা যুক্ত হয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসন নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা থামছেই না। এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী এম আবদুল (এম এ) লতিফ। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য জিয়াউল হক সুমন। একদিকে তিনবারের সাংসদ অন্যদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশের সমর্থন দুটো মিলে দুজনের মধ্যে জয় পেতে তুমুল প্রতিদ্বদন্দ্বীতা হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পটিয়া উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। এবার মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত বর্তমান সাংসদ সামশুল হক চৌধুরী। এই আসন থেকে ২০০৮ সাল থেকে তিন দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সামশুল। ফলে দুজনের মধ্যে ভোটের লড়াই চলবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে তৃতীয়বারের মতো নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তবে নজরুল ইসলামের পথের কাঁটা হতে যাচ্ছেন চন্দনাইশ উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। বর্তমানের সাংসদেও ন্যায় আবদুল জব্বারেরও রয়েছে সমান জনপ্রিয়তা। ফলে এই আসনেও পাল্টে যেতে পারে ভোটের হিসাব নিকাশ।

চট্টগ্রাম-১৫ আসন থেকে তৃতীয় দফায় নৌকার টিকিট পেয়েছেন আবু রেজা মো. নেজামউদ্দিন নদভী। তবে এই আসনে ভাগ বসাতে মরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব। দুজনেরই রয়েছে বিপুল কর্মী-সমর্থক। ফলে এই আসনেই পাল্টে যেতে পারে ভোটের হিসাব নিকাশ।

একইভাবে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আবারও নৌকার টিকেট পেয়েছেন বর্তমান সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান। তবে এবার মোস্তাফিজের আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভাগ বসাতে মরিয়া মনোনয়ন বঞ্চিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শিল্পপতি মুজিবুর রহমান (সিআইপি)। এছাড়াও একই দলের আরেক নেতা আব্দুল্লাহ কবির চৌধুরী লিটনও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ১৪ দলের সমন্বয়ক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, মাঠের বিরোধী দল না থাকায় দল সবাইকে একটা সুযোগ দিয়েছে। তবে, আমি মনে করি, হাইব্রিড এবং অন্য চেতনাধারীদের বয়কট করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করা উচিত হবে। ইতোমধ্যে দুয়েকজন বাদ পড়েছেন। আরও দুয়েকজন যারা আছেন তাদেরকেও আমার দল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসীরা বয়কট করবে।

স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, যেহেতু বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেনা সেহেতু নির্বাচনকে উৎসব মুখর, প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে দল ঐক্যবদ্ধ। পাশপাশি কেন্দ্র্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং অর্থবহ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দল প্রস্তুত।

দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দলের হাইকমান্ড ঘোষণা দিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হতে কোনো বাধা নেই এমনকি কোনো শাস্তিও নেই।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান বলেন, যেহেতু বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না, আমাদের দলের অনেকেই স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এটা এক ধরনের ইতিবাচক দিক। যার ফলে নির্বাচন হবে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক।

দেশ বর্তমান/এআই