চট্টগ্রামের ইতিহাসবিদ শ্রীপূর্ণচন্দ্র চৌধুরী দেবব্রহ্মা তাঁর ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে চট্টগ্রামের ৩২টি নামের উল্লেখ করছেন। আর ঐতিহাসিক আবদুল হক চৌধুরী লিখেছেন তিন ডজন আর আমাদের সংগ্রহে রয়েছে ৪৬টি নাম।
একটি জেলা বা স্থানের এতো নাম বিশ্বে আর আছে কিনা সন্দেহ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম- (১) শ্যাত জাম (আরবী), (২) শ্যাত গাঙ্গ (আরবী), (৩) সামন্দর (আরবী), (৪) চৈত্যগ্রাম (বৌদ্ধ), (৫) চট্টভট্ট (হিন্দু), (৬) চাটিগাঁ (পীর বদর শাহ), (৭) চতকাঁও/চাটগাঁও (ফারসি), (৮) চাটিগাম (ফারসি), (৯) চাটিগ্রাম (আরবী+সংস্কৃত), (১০) চিৎ-তৌৎ-গং (আরাকানী), (১১) সুদকাওয়ান, (ইবনে বতুতা-আবদুল হক), (১২) সতের কাউন (ইবনে বতুতা-শ্রীপূর্ণচন্দ্র), (১৩) জালন্ধর/জ্বালনধারা (১৪), চইট্টে গং (আরাকানী), (১৫) চাটি কিয়াং (চীনা), (১৬) জেটিগা (১৬৬০ খৃঃ ফ্যনড্রেন ব্রুক অঙ্কিত মানচিত্রে), (১৭) চার্টিগান (পরিব্রাজক রাফল ফিচ ১৫৫০), (১৮) চতুঃগ্রাম, (১৯) চট্টল (২০) চক্রশালা (২১) চন্দ্রনাথ (২২) সপ্তগ্রাম (২৩) চরতল (২৪) চিতাগঞ্জ (২৫) চিৎগাঁও (২৬) শ্রী চট্টল (২৭) সাতগাঁও (২৮) সীতাগঙ্গা/সীতাগাঙ্গ (২৯) পুষ্পপুর (৩০)রামেশ (৩১) কর্ণবুল (৩২) সহরে সবজ (আরবী) (৩৩) পার্বতী (৩৪) খোর্দ-আবাদ (ফারসি) (৩৫) পুর্টোগ্রাণ্ডো (৩৬) আনক (৩৭) রোশাং (৩৮)মগরাজ্য (৩৯) আদর্শ দেশ (৪০) সুম্মদেশ (৪১) ক্লীং বা কালেন (৪২) রম্যভূমি (৪৩) ফতেহাবাদ (৪৪) ইসলামাবাদ (৪৫) চট্টগ্রাম (৪৬) চিটাগাং।
তবে বর্তমানে এই জেলা ‘চাটিগাঁ’, ‘চাটগাঁ’, ‘চট্টগ্রাম’ ও ‘চিটাগঙ্গ বা চিটাগাং’ নামে স্থানীয় ও দেশ-বিদেশে পরিচিত। কিন্তু এর মূল বা আদি নাম কোনটি তা চট্টগ্রামের ইতিহাসবিদেরা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। ফলে গোত্র, গোষ্ঠীক, ধার্মীক, স্থানিক, কালীক বিষয়কে সামনে এনে নানা গাল গল্প ডালপালা মেলেছে এই জেলার নামকে কেন্দ্র করে। যার অধিকাংশের কোনো ভিত্তি নেই। আমরা আরবদের দেয়া ‘শ্যাৎজাম’ এবং ‘শ্যাৎগাঙ্গ’ নাম দুটিকে নির্বাচন করেছি।
আমরা মূল নামের অনুসন্ধানে ভূ-প্রকৃতি, ইতিহাস, মানচিত্র, পরিব্রাজক, প্রাচীন ইতিহাস ইত্যাদির সাথে এ এলাকার শাসনে আরাকানী, আরবী, হিন্দু, বৌদ্ধ, সুলতানি, মুঘলি ও ইংরাজ আমলে প্রচলিত, ব্যবহৃত নামের তালিকা তুলে এনেছি। এছাড়া মূলনামের উৎস খোঁজে পেতে সক্ষম হয়েছি।
আরবদের দেওয়া নাম নেয়ার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা যাক :
বিখ্যাত ঐতিহাসিক মিঘ ব্রাউন বলেছেন, ‘আরবীয়ানরা বিশ্বকে সর্বপ্রথম ইতিহাস লেখন শিক্ষা দেয়। তাহাদের ইতিহাস লেখার বৈশিষ্ট্য ছিল যে, প্রকৃত ঘটনার সাথে কাল ও অবস্থা সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞাত হওয়া যেত। যেহেতু তাহাদের মত উপযুক্ত ইতিহাস কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপেও পরিদৃষ্ট হয়নাই। .. .. অতি বাস্তব ও প্রকৃত ঘটনা এই যে, মুসলমানেরাই বিশ্বে সর্বপ্রথম ইতিহাস লেখার সূত্রপাত করে। ইহার পর এরূপ ত্বরিত গতিতে উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে যে, ইউরোপ অদ্যাবধি উহার সমপর্যায়ে আসতে সক্ষম হয় নাই.. ..মুসলমান তথা আরববাসীরাই বিশ্বে ইতিহাসের সূত্রপাত করেছে। এদের পূর্বে জগতে ইতিহাস লেখার কোন সুনিয়মিত ব্যবস্থা ছিল না।’
সুতরাং চটিগাঁও বা চাটিগা বা চট্টগ্রাম ও চিটাগাং নামের উৎস সন্ধান করতে সর্বপ্রথম আরবদের দেওয়া নাম সমুহকে প্রাধান্য দিতেই হবে।কারণ,দুই হাজার সালের অনেক পূর্ব থেকেই চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিলো।সে সময় আরবেরা ছাড়া আর কারো বাণিজ্য বহরের বা ব্যবসা ব্যবসায়ীর সন্ধান যেমন জানা যায় না, তেমনি আরবীয় ঐতিহাসিক ছাড়া অন্য কোন দেশীয় ইতিহাসবিদদের ইতিহাস রচনার ইতিবৃত্তও অজ্ঞাত।
আরবেরাই আরব সাগর, লৌহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরে সর্বপ্রথম নৌ-পথের আবিষ্কারক। তারাই প্রাচ্য-প্রতিচ্যের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযোগ স্থাপন করেছে। খগোল বিদ্যায় পারদর্শি আরবেরা অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ ও নক্ষত্রের উদয়াস্তকে কেন্দ্র করে নিজস্ব তৈরি কম্পাস এবং দুরবীন ব্যবহার করে মৌসমি বায়ুর প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বড় বড় সর/পালের জাহাজ পরিচালনা করতে সক্ষম ছিল। আরবদের নৌ-পথ আবিষ্কার সম্বন্ধে ড. সুনীতি ভূষণ কানুন গো তাঁর চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেন- The Arabs were born traders…Their profound knowledge in navigation,in the science of latitude and longitude, in stronomical phenomena and in the geography of the countries they visited,made them unrivalled in marcantile activities in the Indian Ocean for centuries together.So deep was the mark of their influence on the art of navigation and the manufacture of marine craft….(A History of Chittagong- D. Suniti Bhushan Qanungo)
ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, খ্রিষ্টপূর্ব দুইশতক হতেই এয়মন ও ব্যবিলনীয় অঞ্চলের অমুসলিম আরবগণ চীন ও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সহিত ব্যবস্যা-বাণিজ্যেও একচেটিয়া অধিকারী ছিল। সিংহল, মালাক্কা, কালিকট, চাটগাঁও, যাভা, সুমাত্রা, মালয় ও ক্যানটনে এদের বাণিজ্যিক একাধিপত্য ছিল। সেই সময় হইতে পনর শতকে ওলন্দাজদের আগমন পর্যন্ত সে একাধিপত্য অটুট ছিল।
চাটগাঁ এইভাবে দুই হাজার বছরের অধিককাল পর্যন্ত এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দররূপে পরিগণিত ছিল এবং পশ্চিমে আরব, আবিসিনিয়া, এমন, আশিরিয়া, গ্রীস, রোম এবং পূর্বে চীনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করত (বাংলাদেশের কালচার-আবুল মুনসুর আহমদ, পৃ ২৪৯ এবং বন্দর শহর চট্টগ্রাম- আবদুল হক চৌধুরী, পৃ. ৩৭)
আরব সাগর, লৌহিত সাগর, ভারত মহাসাগর অঞ্চলের বন্দরসমূহের নাম ‘আরব বণিক’দের দেওয়া। যেমনÑ আফ্রিকার ‘বার-ইল-বানাদির, বন্দর মীনাভাম, মালয়েশিয়ার ‘বন্দর পেঙ্গারাম’। এছাড়া ‘বন্দর আল-কেইরান’, ‘বন্দর নাছ’, ‘বন্দর আব্বাস’ (ইরান), ‘বন্দর রেসুত’ এবং ‘বন্দর চাটগাঁ’। (এটি আরবদের দেওয়া ‘চাটজাম-চাটগাম’-এর ‘ফার্সী’ ভার্শান) ঐতিহাসিক তালিশ তাঁর ‘আইন-ই-আকবরিতে এর সত্যতা উল্লেখ করেছেন- In the Ain-i-Akbari, the port town of Chittagong has been mentioned as ‘Bander Chatgaon’. Bandel de Chatigao. আরবদের পূর্বে আর কোন দেশ বা জাতি লৌহিত সাগর, আরব সাগর,ভারত মহা সাগর, বঙ্গোপসাগরে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসেনি। খ্রিস্টের জন্মের অনেক পূর্র থেকেই আরবদের একচেটিয়া দখলে ছিলো মধ্য এশিয়া থেকে এশিয়ার ভারত, মালয়, জাভা, জাপান, চায়নার সব বন্দর। আরব থেকে চীন পর্যন্ত নৌপথ তাদেরই আবিষ্কার।
চট্টগ্রাম বন্দর তথা চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেবব্রহ্মার লেখায়ও ফাহিয়ান, ডিওন, ক্লিমেন্স, জোহান্স, টালেমি, ট্রাবো, প্লিনি এবং ইবনে বতুতা, ঈদৃশী প্রভৃতি ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠেও চাটিগাঁর সঙ্গে আরব বণিকদের সুবিস্তৃত বাণিজ্যের কথা জানা যায়। চট্টগ্রামের নানান এলাকায় আরব বসতি গড়ে উঠেছিলো। চট্টগ্রাম তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিক প্রভাবও আরব দেশের জনজীবনে লক্ষ করা যায়। পাক-ইসলামিক যুুগের আরবি কাব্যসংগ্রহ ‘সাবায়ে মুয়াল্লিকায়’ সংগৃহীত সে যুগের প্রখ্যাত আরবী কবি অমুসলিম ‘ইমরুল কায়েস’- এর একটি কসিদায় এ দেশের করণফোলের নাম উল্লেখ দেখা যায়।
‘নাচিম চ্ সাবা যায়াত রিবায়াল করণফোল। পূর্বদেশের লবঙ্গের সুবাসে সুুবাসিত সমীরণ। (আরব হিস্ট্রি এণ্ড ট্রাভেলার্স–ফিদা আলি খাঁ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ম্যাগাজিন, ঢাকা ১৯২৯) এই করণফুল থেকেই ‘কর্র্ণফুলি’ নদীর নাম।
এখানে বসতি স্থাপনের পর থেকে এই বন্দর দিয়েই আরব বণিকেরা বর্তমানের চট্টগ্রাম, আসাম, আরাকানসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মসলা জাতীয় দ্রব্য, কাপড়, সূতা, সূতিকাপড়, সূক্ষ মসলিন, নানা ধরনের মূল্যবান রত্ন-পাথর, খনিজ পদার্থ, মুসব্বর ও আগর ইত্যাদি ক্রয় করে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপে বাজারজাত করত। তৎকালে চট্টগ্রাম ছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্য থেকে আমদানি-রপ্তানিকৃত দ্রব্যসামগ্রীর কেনা বেচার নদীর তীরবর্তী প্রধান কেন্দ্র। আরবীরা এর নাম দিয়েছিল ‘চাহেলে শহর’ বা ‘সমুদ্র তীরবর্তী শহর’। আরবদের ‘বন্দর শহর’ যা বর্তমানের ‘ষোলশহর’।
অমুসলিম আরব বণিকেরাই সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের নানান এলাকায় আরব বসতি গড়ে তুলেছিলো। বন্দর শহর থেকে চারিদিকের কুড়ি মাইল এলাকাব্যাপি আরব বসতির তথ্য ঐতিহাসিক সুনীতি ভূষণ কানুনগো চট্টগ্রামের ইতিহাসে উল্লেখ আছে। ইসলামের আবির্ভাবকালে হযরত মুহাম্মদ (দঃ)- এর মামা হযরত সাদ-ইবনে-আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) তাঁর তিনজন সাথি হযরত সাঈদ (রাঃ), হযরত ওহাব-বিন-আবু কাফছা (রাঃ) ও হযরত যাহাস ( রাঃ) (অন্য সূত্রে : জাফর-ইবনে-আবু তালিব) কে নিয়ে ৬১৫-৬১৬ খ্রীষ্টাব্দে আবিসিনিয়া থেকে জাহাজ যোগে চট্টগ্রাম-বন্দরে পৌঁছে ইসলামধর্ম প্রচার করেন। অমুসলিম আরব, অনারবেরা (স্থানীয়) একসাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় তৎকালীন বঙ্গে চট্টগ্রাম মুসলিম সংখ্যাধিক এলাকায় পরিণত হয়।
ড. এনামুল হকের মতানুসারে চট্টগ্রামে আরবদের মাধ্যমে একটি মুসলিম রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এর প্রধানের উপাধি ছিল ‘সুলতান’। তিনি লেখেন, ‘পূর্বভারতের একমাত্র বন্দর চট্টগ্রাম আরবদের বিশ্রামস্থান ও উপনিবেশে পরিণত হয়।.. .. খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে চট্টগ্রামে আরব প্রভাব এতই বর্দ্ধিত হইয়াছিল যে এই অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র মুসলমান রাজ্য স্থাপিত হইয়াছিল। (ক. আরাকান রাজ সভায় বাংলা সাহিত্য, খ. মুসলিম বেঙ্গলি লিটারেচার- ড. মুহাম্মদ এনামুল হক)
ড. এ এইচ দানিও ডক্টর এনামুল হকের সমর্থক। তিনি চট্টগ্রামে আরব রাজ্য থাকার পক্ষে মত প্রকাশ করে ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে ‘পাকিস্তান ইতিহাস কন্ফারেন্স’-এ লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন। ( Early Muslim contact with Bengal-Dr. A H Dani)
“সুলাইমান (৮৫৩ খৃঃ জীবিত),আবু জায়েদুল হাসান ( সুলাইমানের সমসাময়িক),ইবনে খুরদবা (মৃত ৯১২ খৃঃ), আল মাসুদি (মৃত ৯২৬ খৃঃ), ইবনে হাওকল (৯৭৬ খৃঃ জীবিত), আল ইদরিসি (জন্ম একাদশ শতকের শেষাংশে) আরব পরিভ্রাজক ও ভূগোলবিদের লিখিত বিবরণে.. .. খৃষ্টীয় দশম শতকের মধ্যভাগে আরব প্রভাব এতোটা প্রবল হয়ে উঠে যে,এই সমতলে একটি ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্য স্থাপিত হয় বলে কেউ কেউ অনুমান করেন।শাসনকর্তার উপাধি ছিলো ‘সুলতান’।সম্ভবত মেঘনা নদীর উত্তর তীরবর্তী সমুদ্র উপকুলবর্তী ভূ-ভাগ এই আরব সুলতানের অধীন ছিলো”।(বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান-অধ্যাপক শাহেদ আলী)
`The reference to Arab Noblemen in the works of De Barros and Mv.Hamidullah khan gives evidence of the ambitious projets of the Arabs who might have sometimes become so powerful as to make themselves desirous of the Bengal throne.”(A History og Chittagong-Dr. Suniti Bhushan Qanungo)
চট্টগ্রামের অন্যতম ইতিহাস প্রণেতা সৈয়দ আহমেদুল হক তাঁর গ্রন্থে উল্লেক করেন- In Bangladesh Chittagong is the only city that can claim the glory of greeting the Muslim navigators and visitors from the land of our holy prophet (PBUH)… ..the great sea port of Chittagong attracted the attention of the Arab traders.Some of these traders settled at this place and within a century and a half they did not only establish an independent principality under a Sultan of their own but they did also make a cultural conquest of the vast regions lying between the mouths of the rivers Irrawady and Meghna.(A Short history of Chittagong-Syed Ahmadul Huq)
আরব বণিকদের ব্যাপকভাবে চট্টগ্রামে অবস্থান ও ব্যবসা-বণিজ্যকালে চট্টগ্রাম ছিল প্রধান ‘পোতাশ্রয়’। এইখানে তাঁদের জাহাজসমুহ নোঙ্গর করে রাখতেন। আরবী ভাষায় পোতাশ্রয়ের নাম ‘সুলুকুল বহর’, যা বর্তমানে অপভ্রংশে ‘সুলক বহর’।
আরবী ‘গোদরী’ অর্থ জাহাজ নির্মাণের স্থান বা কারখানা। ‘গুদীর পাড়’, আরব আমলে যেখানে জাহাজ মেরামত ও নির্মাণ হতো। উল্লেখ্য এই দেশে জাহাজ নির্মাণ সামগ্রী ও পরিচালনা সংক্রান্ত এরাক, তাড়া, সুকান, বাদাম, মালুম, সারাং, সুকানি, কছফ, লস্কর, খালাসী ইত্যাদি আরবী- ফারসী শব্দাবলির উৎপত্তিস্থল এই চট্টগ্রামে। আরবী ‘বক্লুন’,‘বাকিল্লাহ’, শব্দের অর্থ সব্জি বাগান। সেই আজকের ‘বাকলিয়া’ বা ‘বুআইল্লা’। আরবি ‘আলকরণ’ অর্থ গন্ডারের শিং। সেদিনের গন্ডারের শিঙ’র আড়তের স্থানটিই আজো ‘আলকরণ’ নামে খ্যাত।
সুটৃকির আরবি নাম ‘আম্বর’ বা ‘ সিকুলবাহা’। বর্তমানের ‘ শিকলবাহা’ আরবদের সুটকি প্রক্রিয়াজাত করনের স্থান। আরবি ‘খুলাসা’ শব্দ থেকেই আজকের বিখ্যাত ‘খুল্সি’ এলাকার উৎপত্তি।
আরবি/ফারসী ‘ফতে গাঁ’ শব্দের বিবর্তিত নাম ‘পতেঙ্গা’। বিজিত স্থান। আরবি ‘হাওয়ালে শহর’ নামের অর্থ ‘শহরতলী’ / ‘উপশহর’, যা আজকের লোক মুখের ‘হালিশহর’।আজকের কুমুদান পাহাড়ে আরবীয়দের কবর দেয়া হতো।কোলাগাঁওÑকর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্ব তীরবর্তী জনপদ। চট্টগ্রামে আগত আরব নাবিকদের বাসস্থান।
সুতরাং চট্টগ্রামের স্থানসমুহের আরবী নামকরণ গুলির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত যে (১) শ্যাৎজাম (২) শ্যাতগাঙ্গ (৩) সামুন্দর (৪) জালন্দর নামগুলি আরবদের দেওয়া।এগুলিই চট্টগ্রামের আদি নাম।এই নামগুলি থেকে ঐতিহাসিকভাবে কোন নামটি গ্রহণীয়,তা এ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের যত নামই উল্লেখিত হোক না কেন “কোনটাই আরব বণিকদের বাংলাদেশে আগমনের সময় হইতে প্রাচীন নয়।
Barnoilli in description historique geographique deL,Ind. threw a suggestion that the name `Chatigan’ originated from Arabic words `Shat’ (Delta) conoined with `Jam’(The Ganga).He labour to probe that, `It was name given by Arabs.’
বার্নোলির “শ্যাতজাম”নামটি নাবিক সোলাইমান মেহেরি এবং সিদি সেলেভিও মেনে নিয়েছেন।তবে তাঁরা লিখেছেন “ শ্যাত-ই-জাম” । Barnoilli’s view is supported by the actual mention of `Shatijam”in the work of Solaiman mahri and Sidi Chelebi. (The Arab Navigation-Suleiman Nadvi)
আরবদের নামকরণকৃত ‘শ্যাতজাম’কে ‘শ্যাত-ই-জাম’ও বলা হয়। ঐতিহাসিক সুনীতি ভূষণ কানোনগো লিখেছেন- It is supposed that Chittagong was known to the Arabs as’Chat-i-jam’,which means the town,situated on the delta or the lower reaches of the river Jam (Jamuna).(A History of Chittagong vol-1, by Dr,Suniti Bhushan Qanango)
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক