গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গাজা থেকে ইসরায়েলে নজিরবিহীন রকেট হামলা চালায়। হামাসের হঠাৎ জ্বলে ওঠাকে ইসরায়েলের জন্য বিশাল সামরিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তাদের আধুনিক প্রযুক্তি আর গর্ব করা গোয়েন্দাদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে না। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রতি তাদের নাগরিকদের যে আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, তাতেও ভয়ংকর চিড় ধরেছে এবং অনেক ইসরায়েলই ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। আর এ কারণেই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ইহুদিবাদী দখলদার শক্তি ইসরায়েল গাজায় নিরীহ নিরাপদ মানুষের উপর ৪০ দিন ধরে নির্বিচারে হামলা করে হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে এবং সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এদের বর্বরোচিত হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মুমূর্ষু রোগী, নারী ও নবজাতক শিশু। অবৈধ দখলদার শক্তি ইসরায়েল এক নারকীয় গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে আর একে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিচ্ছে তথাকথিত মানবাধিকারের বুলি আওড়ান আধিপত্যবাদি যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা।
ইসরায়েল গত ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলার পর সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রথমে বিমান হামলা করলেও পরবর্তীতে এটি স্থল হামলায় গড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, বিমানবাহিনীকে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর একটি দীর্ঘ তালিকা দেয়া হয় যেখানে যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নয় এমন অনেক স্থানকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। শক্তি প্রদর্শনের জন্যই বিস্তৃত পরিসরে ব্যয়বহুল এ হামলায় প্রতিদিনই শতশত ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছেন। তেল আবিব প্রাথমিকভাবে বিমান হামলার সংখ্যা উল্লেখ করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তবে এই তথ্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলার আশঙ্কায় তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করে শুধু লক্ষ্যবস্তুর সংখ্যা প্রকাশ করছে। এক বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, দখলদার শক্তি ইসরায়েল অবরুদ্ধ গাজায় ৪১ হাজার ইউনিট বাড়ি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে। আবাসন ও অবকাঠামো খাতে আনুমানিক প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার করে। এছাড়া ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ চলমান ইসরায়েল ও হামাসের ৩৫ দিনের যুদ্ধে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ৩২ হাজার টন বোমা ফেলেছে। এতে গাজায় ইতোমধ্যে ১২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এবং তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৭০০ জনের বেশি শিশু নিহত হয়েছে।
গত ৩০ অক্টোবর গাজার জনসংযোগ বিভাগের প্রকাশ করা এক তথ্য মতে, প্রথম ২৪ দিনে অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েল ১৮ হাজার টনের বেশি বোমা ফেলেছে। সে হিসাবে ইসরায়েল শুধু ২৪ দিনেই গাজার প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে অন্তত ৫০ টন বা ৫০ হাজার কেজি বিস্ফোরক ফেলেছে। এই পরিমাণ বিস্ফোরক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়ে অন্তত দেড় গুণ বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম। তাছাড়া, ২৩ থেকে ৩০ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় অন্তত ১২ হাজার টন বোমা ফেলেছে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমা যে পরিমাণ ক্ষতিসাধনে সক্ষম তার প্রায় সমান।
কয়েকদিন আগে প্রকাশিত ইসরায়েলি আক্রমণের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গাজার প্রায় ১২ হাজার লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালানো হয়েছে, তবে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ওই পরিসংখ্যানে নিজেদের রণকৌশল উল্লেখ করা হয়নি। বোমার সংখ্যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, গাজায় ব্যবহৃত তেল আবিবের এবারের হামলা কতটা ব্যয়বহুল ও ভয়াবহ। গত কয়েক দিনের হামলায় গাজা ভূখণ্ডে অন্তত ৩২ হাজার টন বোমা নিক্ষেপ করেছে তেল আবিব, যার বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমকে-৮০ বলে দাবি করেছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র এসব বোমা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর থেকেই ব্যবহার করে আসছে। যার ওজন ১২০ কেজি থেকে এক হাজার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়া হামলায় ব্যবহৃত বেশির ভাগ ফাইটার জেটও যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা। ইসরায়েল এরই মধ্যে মিত্র দেশটির কাছ থেকে প্রতিশ্রুত ৭৫টি ফাইটারের মধ্যে ৪০টি এফ-৩৫ হাতে পেয়েছে বলে স্বীকার করেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল গাজায় প্রতিদিন ৬০০ টন বোমা ফেলছে, এসব বোমা পরিবহনের জন্য বিশালকৃতির অন্তত ৩০টি লরির প্রয়োজন। প্রতি এক হাজার কেজি ওজনের বোমার জন্য মার্কিন বিমানবাহিনীর খরচ হয় ১৬ হাজার ডলার। অন্যদিকে ইসরায়েলকে অন্যান্য প্রযুক্তিগত খরচ বাদ দিয়ে প্রতি হাজার কেজি বোমার জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে ২৫ হাজার ডলার। শুধু প্রারম্ভিক ধাঁচের বোমা হামলার জন্য তেল আবিবকে প্রতিদিন গড়ে দেড় কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিমাণ যদি বাড়ানো হয় তাহলে প্রতিদিন এই খরচ দাঁড়াবে আড়াই কোটি ডলারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংঘাতের শুরু থেকে এ বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৭৫ কোটি ডলার। এছাড়া এফ-১৬ বিমান উড়াতে প্রতি ফ্লাইটে এক ঘণ্টায় খরচ হচ্ছে আট হাজার ডলার। প্রতিদিন গড়ে যুদ্ধযানটি ৩০০টি ফ্লাইট দিলে ঘণ্টার হিসেবে এর খরচ দাঁড়ায় ২৫ লাখ ডলার। এ হিসাব মতে ইসরায়েলকে এখন পর্যন্ত এফ-১৬ বিমান উড়াতে খরচ করতে হয়েছে প্রায় সাত কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বোমা হামলাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নজরদারি, পুনরুদ্ধার, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ, আকাশে প্রাথমিক সতর্কীকরণ যানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে আকাশচুম্বী খরচ। তাছাড়া, ইসরায়েল গাজায় বোমা চালানোর জন্য এ পর্যন্ত অন্তত ২০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে এবং সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তিন লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনার খরচ, যার বাইরে রয়েছে চলমান যুদ্ধে স্থল হামলার ব্যয়।
জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু ইসরায়েল বলেছে, হামাসের যোদ্ধারা এসব ভবনের ভেতরে অথবা আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। যে কারণে ইসরায়েলি বাহিনী এসব ভবনকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গণহত্যায় মেতে উঠেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার ৯০৮টি পরিবারকে একেবারে মুছে দিয়েছে অর্থাৎ ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার এই পরিবারগুলোর কোনও সদস্যই আর বেঁচে নেই। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৮৫ সরকারি ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ৪৭টি মসজিদ, ৩টি গির্জাও বিধ্বস্ত হয়েছে। আবাসিক ভবন বিধ্বস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ এর মধ্যে ৩২ হাজার বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০৩টি স্কুল। এগুলোর মধ্যে ৪৫টি স্কুলে আর কোনো ধরনের কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়।
শুধু তাই নয় এবার বর্বর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গত ১৫ নভেম্বর গাজার আল-শিফা হাসপাতালে ঢুকে তান্ডব চালিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে! এদের থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মুমূর্ষু রোগী, নারী ও নবজাতক শিশু। ইসরায়েলও নিশ্চিত করেছে, তারা আল-শিফা হাসপাতালে হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। অবশ্য এ হামলা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্ররোচিত করেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে আল-শিফার একজন চিকিৎসক হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ইসরায়েলি ট্যাংক ও বুলডোজার প্রবেশ করেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ‘হাসপাতালের পরিস্থিতি খুবই হৃদয়বিদারক। ৬৫০ জনের বেশি রোগী এখন হাসপাতালটিতে আছেন। রয়েছেন ৫০০ জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। ইসরায়েলের হামলার কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনিও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কাছে পানি ও অক্সিজেন নেই। ইসরায়েলি ট্যাংক আল-শিফা হাসপাতালের চারপাশে অবস্থান নিয়েছে। সেনারা হাসপাতালে ঘোরাফেরা করছে। যখন-তখন তল্লাশি চালাচ্ছে এবং সেনারা পানি সরবরাহব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। তাছাড়া অভিযানের কারণে কেউ এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যেতে পারছে না।
গাজার বৃহত্তম এই চিকিৎসা কেন্দ্রে রোগী ও চিকিৎসা কর্মীসহ হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক হাসপাতালে এবং এর আশপাশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা গেছে। অবশ্য হামাস তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হাসপাতাল ব্যবহার করার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে এবং এ বিষয়ে কোনও আন্তর্জাতিক কমিটির এসে পরিদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী হামলার আগে আল-শিফা হাসপাতালের চারদিক থেকে ট্যাংক দিয়ে ঘিরে ফেলে। এই হাসপাতালের ভেতরে শত শত রোগী রয়েছেন; যাদের মধ্যে অনেক নবজাতক শিশুও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতাল ‘প্রায় কবরস্থানে’ পরিণত হয়েছে। হাসপাতালের স্থাপনার ভেতরে এবং বাইরে মরদেহ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এমনকি তাদের দাফনের ব্যবস্থাও করা সম্ভব হচ্ছে না। গাজায় টানা প্রায় দেড় মাস ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ১২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না হাসপাতালেও। ইতোমধ্যে গাজার ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ২৬টির চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়ে গেছে।
দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, গাজায় প্রতি ১০ মিনিটে একটি করে শিশু মারা যাচ্ছে। সেইসাথে যতো মানুষ আহত হয়েছে তাদের প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন শিশু। এদিকে জাতিসংঘের হিসেবে ২১ মাস আগে রাশিয়ার পুরো মাত্রায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রায় ৯৭০০ জন বেসামরিক নাগরিক সেখানে মারা গিয়েছে। সে হিসেবে দেখা যায় রাশিয়ায় ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যতজনকে হত্যা করেছে, ইসরায়েল এই এক মাসে তার চাইতেও বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। সব মিলিয়ে গাজার অন্তত ২৩ লাখ মানুষ এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। জাতিসংঘ বলছে বর্বরোচিত নারকীয় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচতে সবাই দক্ষিণের পথে পা বাড়ালেও গাজার কোন জায়গায়ই নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোকে, গাজায় জঘন্য গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধের জন্য ইসরায়েলকে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করে আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।