ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণ জরুরি

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের আত্মদানে বাংলা ভাষাকে জাতীয় জীবনে সগৌরবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্র গঠনে অনুপ্রেরণাই দেয়ানি, বরং দেশে দেশে জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার বিকাশের সংগ্রামকে উজ্জীবিত করে চলেছে তার প্রমাণ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা। বস্তুত: এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার যে দেশগুলো ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে এসেছে তাদের কাছে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের প্রশ্নটি প্রধান ছিলো।  ঐ সব মহাদেশের বিভিন্ন দেশ, জাতি, উপজাতি, নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ ঔপনিবেশিক শাসক কূলের ভাষাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে যেমন আমরা ইংরেজি ভাষাকে গ্রহণ করেছি, তারও আগে ছিল রাজভাষা ছিলো, ফারসি, তারও আগে সংস্কৃতি।  বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠায় রক্ত দিয়েছে ভাষা শহীদেরা।  পাকিস্তানের প্রায় ঔপনিবেশিক শাসকরা উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো।

পূর্ব বাংলার মানুষ তা ব্যর্থ করেছে।  এই জনপদের জাতীয় জাগরণ ঘটেছে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। বলা যেতে পারে, একটি সর্বপ্লাবী সাংস্কৃতিক-সামাজিক নব উদ্ভাসন ঘটেছে এই আন্দোলনের নির্যাস থেকে।  ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যখন ২০০০ সাল থেকে দেশে দেশে উদযাপিত হতে শুরু করে তখন বিশ্বের নানা দেশে মাতৃভাষার বিকাশ, প্রসার ও সংরক্ষণের তাগিদাটি নতুনভাবে সামনে আসে।  সেই সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার তিন মহাদেশের শত শত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, আদিবাসীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির লালন ও তাতে প্রাণাবেগ সৃষ্টি করার স্বপ্ন ও মুকুলিত হতে শুরু করে। জাতিসংঘের মাতৃভাষা দিবস উদযাপন তাদের মধ্যে নতুন আশার সৃষ্টি করে।  নানা করণে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিপন্নতা বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসতে শুরু করে।  আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির প্রতি সপ্রাণ অনুভূতির নানা কর্তব্য হাজির করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের ছয় হাজার ভাষার মধ্যে ২ হাজার ৫০০টি ভাষা বিপন্ন, গড়ে প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা বিপন্ন অথবা মৃত্যু ঘটছে।  আমাদের দেশের সংবিধানে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার ও মৌলিক অধিকারগুলির প্রাপ্যতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।  আমাদের দেশে প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর ৩৯টি ভাষার সন্ধান মিলেছে, এগুলোর মধ্যে ১৪টি বিপন্ন প্রায়।

ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় এ তথ্য জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটির আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অবস্থান ও তাদের ভাষা পরিস্থিতি নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান হয়েছে। তবে এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিপন্ন ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, পাংখোয়া, বেরংমিংচা, চাক, খিয়াং, লালেং ও লুসাই। একটি জাতীয় দৈনিকে বলা হয়েছে, কোন কোন ভাষায় কথা বলে মাত্র গুটিকয়েকজন।  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বয়স্ক মানুষদের মধ্যে তাদের মাতৃভাষার সুলুক সন্ধান পাওয়া যায়, তাদের মৃত্যুর পর তাদের ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এইসব গোষ্ঠীর বর্তমান প্রজন্ম অন্য ভাষার আধিপত্যের কাছে বাঁধা পড়েছে।  পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩৯টি ভাষার মধ্যে ৮টির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে।  এগুলোর মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও মান্দ্রি এই ৫ ভাষায় প্রাক-প্রাথমিকের জন্য পাঠ্যবই রচনা করেছে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড।  তবে গবেষণা ও অনুসন্ধান কালে আরো কয়েকটি ভাষার বর্ণমালা পাওয়া যেতে পারে।  এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বা শিল্পকলা একাডেমি কাজ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা ভাষা বিপন্নতা বা বিলুপ্তির কারণ হিসেবে গোষ্ঠীগত আধিপত্য বিস্তার ও হানাহানি, বহিরাগতদের ভাষার প্রভাব, লিখন বিধি না থাকায় মাতৃভাষায় শিক্ষা ‘জ্ঞানচর্চা বাধাগ্রস্ত হওয়া’, লেখ্য ভাষার অভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক কার্যাদি সম্পন্ন করতে না পারা, আর্থ-সামাজিক জীবিকা ও পেশাগত কারণে বাংলা, ইংরেজিসহ অন্য ভাষা গ্রহণ, স্থানান্তর, দেশান্তর প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা রক্ষায় তাদের জন্য ‘ভাষা কমিশন’, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।  আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা উদ্ধার ও সংরক্ষণে এই দুটি সহায়ক হতে পারে।  তা ছাড়া মৌখিক ইতিহাস, কথা, আলাপ লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা দেওয়া যেতে পারে।  প্রয়োজনে প্রতিবেশি দেশ যেখানে এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে, সে সব দেশের সাথে যোগাযোগ করলে বিলুপ্ত ভাষার, বর্ণমালার সন্ধান পাওয়া হতে পারে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন এসব ভাষার ত্রিÑভাষিক অভিধান প্রণয়ন করা।  ভাষা প্রামাণ্যকারণে এবং সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি সহায়ক হতে পারে।  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে এ ব্যাপারে দ্রæত পদক্ষেপ নিতে হবে।  এ জন্য প্রয়োজন নিষ্ঠ গবেষক দল, এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষিত মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।  সুতরাং এ ব্যাপারে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় সত্তাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাদের জনবৈচিত্র ও বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি বৃহত্তর সমাজে সম্প্রীতি ও ঐক্যের পথ সুগম করে।  সমাজ ও সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদের চর্চা সভ্যতা ও মানব সংস্কৃতিকে প্রাণময় করে তোলে।  প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর ভাষাকে সজীব ও সচল রাখতে পারলে জাতীয় সংস্কৃতির উজ্জ্বল উদ্ধার সম্ভব।