কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুর জন্মদিন আজ

দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পর বাংলাদেশে শুরু হলো ব্যান্ড সঙ্গীত চর্চা। সেই সময় দেশের তরুণদের অনুপ্রেরণা পিংক ফ্লয়েড, বিটলস, ডায়ার স্ট্রেইট বা দা ডোরস’র মতো পশ্চিমা সঙ্গীতের অনেক ব্যান্ড। তাদের কেউ হতে চান মার্ক নফলার, জিম মরিসন। আবার কেউ ডেভিড গিলমোর অথবা জিমি হেন্ড্রিক্স।

এখন যে কিংবদন্তী রক আইকনের কথা বলব তিনি হচ্ছেন দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের পথিকৃত আইয়ুব বাচ্চু। বেঁচে থাকলে পা রাখতেন ৬১ বছরে। হয়ত আনন্দ-আড্ডায় প্রিয়জনদের নিয়ে কাটতেন কেক, সিক্ত হতেন অগণিত ভক্তের ভালোবাসায়। কিন্তু ২০১৮ সালেই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাই ক্যালেন্ডার ঘুরে ১৬ আগস্ট এলেই যেন বিষাদের গল্পটা ফের জেগে ওঠে।

জন্মদিন উপলক্ষে আইয়ুব বাচ্চুকে ঘিরে বিশেষ কোনও আয়োজনের খবর পাওয়া যায়নি। তার দুই সন্তান থাকেন বিদেশে। তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে সংগীতানুরাগীরা পরম ভালোবাসায় তাকে স্মরণ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বন্দনায় পোস্ট দিচ্ছেন।

শৈশবকাল থেকে গিটারের প্রতি তার ছিল অদ্ভুত প্রেম। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সংগীতের প্রতি তার প্রেমটা পরিবার মেনে নেয়নি। পেশা হিসেবে তো আরও না। এসব তাকে কখনোই আটকে রাখতে পারেনি।

আইয়ুব বাচ্চুর বেড়ে উঠা চট্টগ্রামে। ১৯৬২ সালের আজকের এই দিনে চট্টগ্রামে জন্ম নেন নন্দিত এই ব্যান্ড তারকা। ৭০ দশকে স্কুলে থাকতে বাবার কাছ থেকে একটি গিটার উপহার পান। আর সেই থেকেই তার টুংটাং শুরু। কিশোর বয়সে প্রেমের পরেন পশ্চিমা সঙ্গীতের। হয়তো স্বপ্ন দেখতেন জিমি হেন্ড্রিক্স হওয়ার। যাকে আইয়ুব বাচ্চুর টিশার্টে প্রায় দেখা যেত।

দেশের টিভির এক অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চু প্রথম দেখলেন আজম খানের পারফর্মেন্স। তার সঙ্গে ঝাঁকড়া চুলে গিটার বাজাচ্ছিলেন দেশের কিংবদন্তী গিটারিস্ট নয়ন মুন্সি। মুগ্ধ হয়ে যান আইয়ুব বাচ্চু। তখন থেকে নেশা চড়ে যায়। তাই কলেজ জীবনে বন্ধুদের নিয়ে একটি ব্যান্ড গড়লেন। নাম দিলেন “গোল্ডেন বয়েজ”।

চট্টগ্রামে সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় “ফিলিংস” ব্যান্ড। আইয়ুব বাচ্চুর ইচ্ছা ছিল সেই ব্যান্ডে জয়েন করার। কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গে যেহেতু আগেই পরিচয় ছিল তাই সেই ইচ্ছাটাও পুরোন হলো। এতে আইয়ুব বাচ্চু তার গিটারের প্র্যাকটিস আরও ভালোভাবে করার সুযোগ পেয়ে যান। আর তার উদ্দেশ্য ছিল মূলত এটাই। এটা ছিল ১৯৭৮ সালের কথা।

এরপর ১৬ বছর বয়সে “ফিলিংস” থেকে আইয়ুব বাচ্চু প্রথম গান রেকর্ড করেন। শিরোনাম “হারানো বিকেলের গল্প”। গীতিকার ছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ব্যান্ডটিতে তিন বছরের মতো ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। পরবর্তীতে যোগ দেন চট্টগ্রামের আরও একটি জনপ্রিয় ব্যান্ড “সোলস”-এ।

সোলস তখন ছিল চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যান্ডদল। যদিও ৮২ সালের দিকে সোলস ব্যান্ড ঢাকায় মুভ করে। যার কারণে আইয়ুব বাচ্চুও ঢাকায় চলে আসেন। সেই সময়েই সোলসের প্রথম অ্যালবাম, “সুপার সোলস” রিলিজ হয়।

এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, “১৯৮৩ সালের শেষের দিকে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। উঠেছিলাম এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে। তখন এখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকতেন। আমি কারও কাছেই যাইনি। বিপদে কারও মুখাপেক্ষীও হইনি। নিজেকে গড়ে তুলেছি। দিনরাত্রি কাজ করে একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি।”

১৯৮৬ সালে “সোলস”-এ থাকা অবস্থায় নিজের প্রথম একক অ্যালবাম, “রক্তগোলাপ” প্রকাশ করেন আইয়ুব বাচ্চু। এই অ্যালবামের সুর ও সঙ্গীত ছিল তার নিজেরই। কিন্তু এখানে মজার ব্যাপার হলো, অ্যালবামের কভারে সুর ও সঙ্গীতের জায়গায় তিনি তার ডাকনাম “রবিন” ব্যবহার করেন এবং শিল্পীর স্থানে আইয়ুব বাচ্চু ব্যবহার করেন।

ব্যান্ডে আইয়ুব বাচ্চু বেশ সম্ভাবনাময়ী হয়ে উঠলেও একক অ্যালবাম দিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। তবে তিনি থেমে যাননি। ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করেন দ্বিতীয় অ্যালবাম “ময়না”। প্রযোজনায় ছিল তৎকালীন স্বনামধন্য অডিও প্রতিষ্ঠান “সারগাম”। পেছনের ব্যর্থতাকে এবার ছাপিয়ে পান সফলতা। আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়।

১৯৯০ সালে সোলস’র সঙ্গে পথচলার ইতি টানেন আইয়ুব বাচ্চু। উদ্দেশ্য ছিল নিজের ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা। যার ফলপ্রুস ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল জন্ম নিল “এলআরবি”। ১৯৯২ সালে “এলআরবি ১ ও ২” ডাবল অ্যালবাম প্রকাশ করে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে ইতিহাস তৈরি করে “এলআরবি”। মূলত এই অ্যালবামের অনুপ্রেরণা আইয়ুব বাচ্চু পান ইংলিশ রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের ১৯৭৯ সালের প্রকাশ হওয়া “দ্য ওয়াল” থেকে।

পরবর্তীতে ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে “এলআরবি”-র দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম “সুখ” ও “তবুও”। অ্যালবাম দুটির উল্লেখযোগ্য গান মধ্যে “চলো বদলে যাই”, “রূপালি গিটার”, “গতকাল রাতে” সেই সময় সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৫ সালে আইয়ুব বাচ্চু বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম “কষ্ট”। এটিকে সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অবিহিত করা হয়। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে কষ্ট কাকে বলে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, অবাক হৃদয়, ও আমিও মানুষ। একই বছর “এলআরবি”-র চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম “ঘুমন্ত শহরে” প্রকাশিত হয়।

পুরো ক্যারিয়ারে নতুন গান তৈরিতে কখনও থেমে যাননি আইয়ুব বাচ্চু। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তার অ্যালবাম রিলিজ হয়েছে। আইয়ুব বাচ্চু এমন একটি নাম স্টেজে যার গিটারের জাদুতে মেতে থাকতেন ভক্তরা। এ যেন অদ্ভুত এক দ্যোতানা তৈরি করে।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আইয়ুব বাচ্চু শুধু নিজেই মিউজিক করেননি। অন্যতম গিটার বাদকও বটে। আর সেই সূত্র ধরে তিনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক গিটার বাদক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠলেন। এমনকি দেশে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তার অবদান ছিল অন্যতম।

এমএইচএফ