কমিশনকে নজরে রাখবে রাজনৈতিক দলগুলো

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে ছয়টি কমিশন গঠনের যে ঘোষণা দিয়েছেন তাকে স্বাগত জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কমিশন গঠনের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। উদ্যোগ রাষ্ট্রের কল্যাণে গৃহীত হওয়ায় সরকারের কাজে সব ধরনের সহযোগিতা করার কথাও জানিয়েছে দলগুলো। তাদের মতে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুদক, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কি কি রূপান্তর, পরিবর্তন করা যেতে পারে তার একটা বড় রূপরেখা পাওয়া যাবে।

এদিকে কমিশনের কাজের ওপর নজর রাখবে রাজনৈতিক দলগুলো। যেন যে লক্ষ্য নিয়ে সংস্কারের কাজে সরকার হাত দিতে যাচ্ছে তা সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণে পূর্ণতা পায়। অতীতে নানা কারণে রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষেই এটা সম্ভব হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমরা আশা করি এই কমিশনগুলো সেভাবেই কাজ করে যাবে। আমরা তো এ সরকারকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছি। যাতে করে একটা গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে। আমরা সুন্দরভাবে নির্বাচন করতে পারি। মানুষ যেন তার ভোট দেওয়ার অধিকার ফিরে পায়। সেজন্যই তো আমাদের এতদিনের আন্দোলন। আমরা যে ১৫ বছর আন্দোলন করেছি, এত কষ্ট, অত্যাচার সহ্য করেছি। এখন তিনিও এটা বলেছেন, ঘোষণা দিয়েছেন। আমরাও আশা করি সেটা তারা করতে পারবেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার যুগান্তরকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন। সরকারের পরিকল্পনা ও রাষ্ট্র সংস্কারে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সারা দেশে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হাজার ছাত্র-জনতা শহিদ হলেন, আহত হলেন, এসব ব্যাপারে অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন। সংস্কারের জন্য তিনি বিভিন্ন কমিশন ও তার দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এটা একটা প্রয়োজনীয় কাজ। এখন যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমার মনে হয় এটা খুব সিরিয়াসলি মনিটরিং করতে হবে, যেন আবার কোনো বিতর্ক তৈরি না হয়। পরিষ্কার করতে গিয়ে যেন সেই পতিত স্বৈরাচারের ঝঞ্জাল নতুন করে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা পরিকল্পিত ও সুচিন্তিতভাবে এগোচ্ছেন। আমরা আশা করি তিনি জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু যুগান্তরকে বলেন, শুরুর দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার করবেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি ছয়টি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই কমিশনের জন্য যে ছয়জন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা খুবই পরিচিত মুখ এবং গ্রহণযোগ্য মানুষ। আমরা আশাবাদী যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা তাদের সঙ্গে আরও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে ৩ মাসের মধ্যে রিপোর্ট তৈরি করতে পারবেন। আমাদের দিক থেকে এ উদ্যোগকে পুরোপুরি ইতিবাচক হিসাবেই দেখছি। আমরা মনে করি প্রধান উদেষ্টা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নে এটা গুরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যারা কাজ করবেন তাদের পার্টির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণের মুখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, এই সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। যদিও এই লড়াইয়ে নানা ধরনের শক্তির ইনভলভমেন্ট (অংশগ্রহণ) ছিল। আমরাও ছিলাম। এ আন্দোলন ছিল স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ফলে যারা আজ রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেছে, তাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই দুই বুর্জোয়া দল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্যারি (ধারণ) করতে পারেনি। ওয়ান-ইলেভেন এসেছিল আওয়ামী লীগ-বিএনপির সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণে। এটাও একই জায়গা থেকে এসেছে। যদিও দুটার প্যাটার্ন (ধরন) আলাদা। তখন সেটা ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সাপোর্টে। আর এখন সরকার হয়েছে, ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণজাগরনের মধ্য দিয়ে। ফলে সংস্কারের পাশাপাশি এই সরকারের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত গণতন্ত্রের রীতিনীতি ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার করা।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, কমিশন গঠনের উদ্যোগকে আমি ইতিবাচক হিসাবেই দেখি। তারা রাজনৈতিক দলসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গেও আলোচনা করবেন। সুপারিশ তৈরি করে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন। আমরা আশা করি এটা সফলভাবে সম্পন্ন হবে। অক্টোবর থেকে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে তারা এর কাজ শেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে গোটা এজেন্ডা সামনে নিয়ে আসবেন। রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকার আলাপ-আলোচনা করে কোন কোন ক্ষেত্রে কি কি রূপান্তর, পরিবর্তন করতে পারি তার একটা বড় রূপরেখা পাওয়া যাবে। আমি মনে করি সরকার যেটাই করুন না কেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই এটা করা হবে। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, আমরা এটাকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসাবেই দেখি। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে দেশের জনগণের চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশার আলোকে রাষ্ট্র সংস্কারের নিমিত্তে ছয়টি কমিশন করে দিয়েছেন। যাদের এখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি। তারা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। প্রধান উপদেষ্টা একটা দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন তারা ৩ মাসের মধ্যে একটা ড্রাফট তৈরি করবেন। পরবর্তীতে ওই কমিটিসহ সরকার রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের মতামত নিয়ে পরিপূর্ণতা দেবেন।

তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থানের পরে রাষ্ট্র সংস্কার সব মানুষের চাওয়া। একটা রাষ্ট্রের যতগুলো প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেনি। যে কারণে ক্ষমতাসীনরা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে। ফলে এ গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা আর চাই না-আর কোনো স্বৈরাচারী কাঠামো থাকুক বা স্বৈরাচারী কাঠামো তৈরি হতে পারে এমন কোনো ব্যবস্থা থাকুক।