প্রসব বেদনা নিয়ে কক্সবাজার শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হন হতদরিদ্র মাফিয়া বেগম (৩৮)। ওইদিনই সিজার করেন ক্লিনিকটির দায়িত্বে থাকা স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ (গাইনি) বিশেষজ্ঞ ডা. খাইরুন্নেছা মুন্নি। অপারেশন শেষে পেটের মধ্যে একটি কাঁচি রেখেই সেলাই করে দেন চিকিৎসক। যা বুঝতে বুঝতেই আর অপসারণ করে গিয়েই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন ভুক্তভোগী এক দম্পতি।
ভুক্তভোগী মাফিয়া বেগম কক্সবাজার শহরের পেশকার পাড়া এলাকার মো. ইউসুফের স্ত্রী। তাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরে হলেও, দীর্ঘ দিন ধরে পেশকার পাড়ার একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
তাদের অভিযোগ, ভুক্তভোগী ওই নারী অপারেশনের পর থেকে প্রায় ১৩ মাস ধরেই শরীরে নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সময় ডাক্তার, কবিরাজসহ বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু সুস্থ হতে পারেননি। ধীরে ধীরে যাচ্ছিলেন মৃত্যুর দিকে। তার চিকিৎসা চালাতে গিয়ে স্বামীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্থাবর-অস্থাবর সহায় সম্পত্তি সব খুইয়ে অভাব অনটনে দিনাতিপাত করছেন।
চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা দেওয়ার কথা দিয়েও কথা রাখেনি চিকিৎসক। উল্টো সেই টাকা চাইতে গিয়ে ওই নারী চিকিৎসকের হুমকি-ধমকিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবারটি।
ভুক্তভোগী মাফিয়া বেগম জানান, অপারেশনের পর থেকে পেটে ব্যথা শুরু হলে তিনি ডা. খাইরুন্নেছা মুন্নির চেম্বারে যান। ডা. মুন্নি তাকে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্যথানাশক খেয়ে প্রায় ১৩ মাস ধরে চেপে রাখেন পেটব্যথা। কিন্তু কোনো পরিবর্তন না দেখে মাফিয়া বেগম কখনো ঢাকা, কখনো চট্টগ্রাম কখনো গ্রাম্য ডাক্তার, এমনকি যখন যে যা বলেছে, সেখানেই ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন একটু ভালো থাকার আশায়। গেল বছরের আগস্টে তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে যান। সেখানে ওইদিন বারবার চেকআপ করার পর এক্স-রে তে তার পেটের মধ্যে একটি ৯ ইঞ্চি কাঁচি ধরা পড়ে। এরপর তাকে আবারও দ্রুত অপারেশন করে কাঁচি বের করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
মাফিয়া বেগম আক্ষেপ করে জানান, ২০২২ সালের ২২ আগস্ট প্রচণ্ড প্রসব বেদনা নিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে যান। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র যেতে পরামর্শ দেন। তখন তিনি তাৎক্ষণিক কোনো উপায় না দেখে ডা. খাইরুন্নেছা মুন্নির শরণাপন্ন হন। ডা. মুন্নি জরুরিভাবে সিজার করেন, তবে নবজাতকটি মৃত বলে ঘোষণা দেন। তিনদিন পর রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর পেট ব্যথা শুরু হলে, পুনরায় তিনি ডা. মুন্নি কাছে যান। তখন ডা. মুন্নি মাফিয়া বেগমকে সিজারের পর একটু স্বাভাবিকভাবে ব্যথা হয় বলে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। দিনের পর দিন ব্যথার তীব্রতা বাড়তে শুরু করলে, দিক্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন পরিবারটি। বারবার ছুটে যান ডাক্তার মুন্নির কাছে। প্রতিবারই একই কায়দায় বিভিন্ন পরীক্ষা করে রিপোর্টে কিছু না পেয়ে রোগীকে রেস্ট করতে বলেন ওই ডাক্তার।
এভাবে দিনের পর দিন ব্যথার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও খুলনায় বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন মাফিয়া। প্রতিবারই ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মাফিয়ার শরীর স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
সর্বশেষ এক বছর ৫ দিন পর ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখান মাফিয়া বেগম। ডাক্তারকে এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাফি করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। ডাক্তার তার অনুরোধে বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘ডাক্তার আমি, নাকি তুমি.? কি পরীক্ষা দিতে হবে, না দিতে হবে- তা আমি বুঝব’ বলে তাড়িয়ে দেন।
পরদিন আবার টিকিট কেটে অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে এক্স-রে করেন মাফিয়া। এক্স-রের রিপোর্ট দেখে টেকনিশিয়ান ও রোগীর পরিবারের স্বজনদের চোখ তো ছানাবড়া! রিপোর্টে দেখা যায়, আস্ত একটা কাঁচি তার পেটের ভেতরে।
ভুক্তভোগী মাফিয়া বেগমের স্বামী মো. ইউসুফ জানান, হাসপাতালের ল্যাব টেকনিশিয়ানের কাছে রিপোর্ট চাইলে, তারা কোন ডাক্তারের কাছে সিজার করিয়েছি জানতে চান। পরে ডা. খাইরুন্নেছা মুন্নির নাম বললে, পরীক্ষার রিপোর্টটি গায়েব করে ডাক্তার খাইরুন্নেছা মুন্নিকে খবর দেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার সাঙ্গোপাঙ্গ পাঠিয়ে, একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশাতে করে তার চেম্বারে নিয়ে যান। এসময় ডাক্তার মুন্নি নানা ধরনের হুমকি দেন। পরে কাকুতি-মিনতি করে ওই দিন সন্ধ্যা ৬টায় অপারেশনের মাধ্যমে কাঁচি বের করে দেবেন বলে শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেন।
ভুক্তভোগীর স্বামী আরও জানান, তার এমন তাড়াহুড়ায় ভুক্তভোগী পরিবারটির মনে নানা সন্দেহ জন্ম দিলে, স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে জানিয়ে মুন্নির চেম্বার থেকে সটকে পড়েন তারা। এমতাবস্থায় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে পেট থেকে কাঁচি বের করতে ডাক্তার মুন্নি দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তার তত্ত্বাবধানে অপারেশন করতে অপারগতা প্রকাশ করলে, তিনদিন পর মুন্নি সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সেলিম উল্লাহ খাঁন নবাবের মাধ্যমে অপারেশন করে সেই কাঁচি বের করে নেন।
সেইসঙ্গে পেটের ভেতরে কাঁচি রেখে সেলাই করার বিষয়টি গোপন রাখার জন্য রোগীর চিকিৎসা বাবদ ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবেন বলেও আশ্বাস দেন।
অসহায় মো. ইউসুফ আরও জানান, ডা. খাইরুন্নেছা মুন্নি নিজের দেওয়া কথামতো, ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিলেও বাকি টাকা তিনি দিচ্ছেন না। এদিকে রোগীর শারীরিক অবস্থা দিনদিন অবনতি হতে থাকে। রোগী এখন অস্বাভাবিক হয়ে গেছেন। ঠিকমত কাজ করতে পারেন না। হাঁটাচলা করতে পারেন না। শরীর দিনদিন অবশ হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে এই মুহূর্তে ডাক্তারের কাছে টাকা চাইলেও দিচ্ছেন না। চিকিৎসার খরচ চালাতে নিজের কাপড়ের ব্যবসা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে তার।
বিষয়টি মিডিয়া ও বাইরে জানাজানি করে দিলে, ডা. মুন্নি উল্টো প্রাণে মারাসহ বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী পরিবারটি।
ইউসুফ বলেন, তার কাপড়ের দোকান, শেষ সম্বল যা ছিলো- সব বিক্রি করে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন স্ত্রীর চিকিৎসার পেছনে। ফুটপাতে হকারের ব্যবসা করেও বর্তমানে দুবেলা দুমুঠো খাবার পর্যন্ত ঠিক মতো জোটে না। ডা. খাইরুন্নেছা মুন্নির ভয়ে আদালত বা প্রশাসনের কাছেও অভিযোগ দিতে যেতে পারছেন না। এমতাবস্থায় একদিকে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে; অন্যদিকে ডাক্তার মুন্নির অব্যাহত হুমকিতে স্ত্রীকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলেই জানালেন তিনি।
ভুক্তভোগী মাফিয়া বেগমের ফুফু হাসিনা আক্তার বলেন, সিজার করার পর থেকে তার ভাতিজি ব্যথায় কাতর হয়ে দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় কাটিয়েছেন। প্রতিদিন ব্যথার যন্ত্রণায় কাতর মাফিয়ার চিৎকারে আল্লার আরশ পর্যন্ত কেঁপে ওঠার মতো অবস্থা। তার কাণ্ড দেখে প্রথমে প্রথমে আমরাও হাসাহাসি করতাম। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলতাম সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়ে যে অবস্থা শুরু করেছো; আর কাউকে দেখিনি তোমার মতো এমন ছেলেমানুষী করতে। পরে জানতে বাকী থাকেনা যে, তার শরীরে কিছু একটা হয়েছে। পরে ওটাই সত্যি হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডা. খাইরুন্নেছা মুন্নির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে অভিযুক্ত ডাক্তার মুন্নির ঘনিষ্ঠ হিসেবে জনশ্রুতি থাকা সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সেলিম উল্লাহ খাঁন নবাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি অপারেশনের মাধ্যমে পেট থেকে কাঁচি বের করার বিষয়টি স্মরণ নেই বলে জানান।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ এখনো পাইনি। যদি এরকম হয়ে থাকে, তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।