ঋষি সুনাক: ওয়েটার থেকে প্রধানমন্ত্রী

বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে ঘিরে ভারত-পাকিস্তান সহ সর্বত্রই চলছে নানান আলোচনা। ভারতীয় বংশোদ্ভুত, ব্রিটেনের প্রথম হিন্দু প্রধানমন্ত্রী, ওয়েটার থেকে প্রধানমন্ত্রী নানান আলোচনা মিডিয়া পাড়ায়।

তার কারণও অবশ্য খুব একটা গৌণ নয়, এক সময় বৃটেনের সাউদাম্পটনে রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করা ঋষি সুনাক সবাইকে চমকে দিয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। তিনি হয়েছেন কমপক্ষে ২০০ বছরের মধ্যে বৃটেনের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। প্রথম ভারতীয়, প্রথম হিন্দু প্রধানমন্ত্রী।

মাত্র সাত বছরের মধ্যে রাজনীতিতে এসে যেন জাদু দেখালেন ঋষি। এ সময়েই তার মোহময় এক উত্থান ঘটেছে। ২০১৫ সালে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। তারপর মাত্র ৭ বছরেই ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের দরজা খুলে গেছে তার জন্য। অথচ কিশোর বয়সে ছুটির দিনে সাইকেল চালিয়েই বেশি সময় কেটেছে তার। ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতেন।

তাতে বাড়তি কিছু রোজগার হতো। পরিবারকে সাহায্য করা হতো। এক সময় সাউদাম্পটনে একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারেরও কাজ করেছেন। সেই ঋষি সুনাকই হলেন বৃটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল বৃটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস তার সময়ে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঋষি সুনাককে নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম ভাষণে তিনি বৃটেনে শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস), উন্নত স্কুল, নিরাপদ সড়ক, সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সুরক্ষা, সামরিক বাহিনীকে সমর্থন ও মান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বাকিংহাম রাজপ্রাসাদে রাজার সঙ্গে সাক্ষাতে তাকে নিয়োগ করেন রাজা চার্লস। সেখান থেকে সোজা ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনের সামনে চলে যান ঋষি সুনাক। সেখানে আগে থেকেই নিয়ম অনুযায়ী স্থাপন করা লেকচার্ন-এর সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ভাষণ দেন। এ সময় তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পক্ষান্তরে সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস কিছু ভুল করেছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ঋষি সুনাক বলেন, লিজ ট্রাস দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চেয়েছিলেন। এটা তার ভুল ছিল না। এটা ছিল একটি আদর্শ লক্ষ্য। লিজ ট্রাস পরিবর্তন সৃষ্টি করতে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কিছু ভুল করেছেন তিনি। অসৎ উদ্দেশ্য বা খারাপ ইচ্ছা থেকে এসব আসেনি। কিন্তু তার উল্টোটা ঘটেছে। তা সত্ত্বেও ভুল হয়ে গেছে। পূর্বসূরি যে ভুল করেছেন তা ঠিকঠাক করার প্রতিশ্রুতি দেন ঋষি সুনাক।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষেক ভাষণে তিনি বলেন, তিনি জানেন ২০১৯ সালে কনজারভেটিভ পার্টি যে ম্যান্ডেট অর্জন করে তা কারও একার সম্পত্তি নয়। পক্ষান্তরে এই ম্যান্ডেট হলো আমাদের সবার জন্য। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য।

তিনি আরও প্রতিশ্রুতি দেন। বলেন, তার সরকারের প্রতিটি স্তরে থাকবে সততা, পেশাদারিত্ব এবং স্বচ্ছতা। তিনি বলেন, আস্থা অর্জন করতে হয়। আমি আপনাদের আস্থা অর্জন করবো। বক্তব্য শেষ করে তিনি ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের গেটে গিয়ে থামেন। পেছন ফিরে সবার উদ্দেশে হাত নাড়েন। এরপর প্রবেশ করেন ভেতরে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটাই ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে তার প্রথম পদার্পণ।

এর আগে কনজারভেটিভ দলের নতুন নেতা ঋষি সুনাককে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন রাজা তৃতীয় চার্লস। গতকাল এ ঘটনার আগে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন তিনি। নতুন সরকার গঠনের জন্য ঋষি সুনাককে আমন্ত্রণ জানান। লিজ ট্রাস বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই সেখানে প্রবেশ করেন সুনাক।

এরপর রাজার সঙ্গে প্রাসাদের ১৭৪৪ নম্বর কক্ষে সাক্ষাৎ হয় ঋষি সুনাকের। এ সময় ঋষি সুনাককে বৃটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন রাজা। এর মধ্য দিয়ে তিনি হলেন বৃটেনের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে বৃটিশরা এই একটি বছরে পেলেন তিনজন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে থেকেই নতুন মন্ত্রীপরিষদে কার কার স্থান হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায় কনজারভেটিভ দলের সাবেক নেতা ইয়ান ডানকান স্মিথ বলেন, মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া উচিত শুধু মেধার ওপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেছেন, প্রথমেই ১৫ জন নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত।

অনলাইন আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ঋষি সুনাকের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বৃটিশ-শাসিত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা। স্বচ্ছন্দ জীবিকার খোঁজে সুনাক পরিবারের সদস্যরা পূর্ব আফ্রিকায় পাড়ি দেন। সেখানে প্রবল ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে তারা চলে যান বৃটেনে। ঋষির মা ঊষার পরিবারের কাহিনীও তেমনই সাহসের।

ঊষার মা, অর্থাৎ ঋষির দিদা ছিলেন তাঞ্জানিয়ার বাসিন্দা। নাম ‘স্রাক্ষা’। সেখানে বাস করতেন পাঞ্জাবি সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। বিয়ের পর ঋষির দিদা নিজের গয়না বিক্রি করে সেই টাকায় বৃটেন যাওয়ার টিকিট কেনেন। একটিই টিকিট। এবং সেটিও শুধু যাওয়ার, ফেরার নয়।

১৯৬৬ সালে স্বামী, সন্তানকে বাড়িতে রেখে রোজগারের উদ্দেশে একেবারে একা বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের লেস্টারে গ্রন্থাগারিকের কাজ নেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে একা একা এক বছর কঠিন পরিশ্রম করে যা উপার্জন করেছিলেন, তা দিয়ে পরিবারের খরচ চালানোর ক্ষমতা তৈরি করে ফেলেছিলেন স্রাক্ষা। পরে পরিবারের বাকিরাও চলে যান তার কাছে।

ঋষির মা ঊষা অস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়তেন। সেখানেই ডাক্তারি পড়ুয়া যশবীরের সঙ্গে তার দেখা এবং পরিচয়। অতঃপর প্রেম এবং বিবাহ। বিয়ের পর যশবীর-ঊষা সাউদাম্পটনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের তিন সন্তান।

ঋষি সুনাক বড় ছেলে। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো তিনি। আবার দারুণ আগ্রহ খেলাধুলোতেও। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি- সবই খেলতেন। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষিকা জুডি গ্রেগরির কথায়, ক্লাসে ঋষিকে দেখেছি সবচেয়ে শান্তশিষ্ট অথচ সকলের খেয়াল রাখা একটা ছেলে। ভিড়ের মাঝেও কীভাবে যেন আলাদা করে সবার নজর কাড়তো ও। ঋষির সুনাকের ভাই সঞ্জয় পেশায় মনোবিদ। আর বোন রাখি কাজ করেন জাতিসংঘে।

মানবজমিন