উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলাজট

বিচারাধীন মামলা ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩

দেশের আদালত গুলোতে মামলাজট বাড়ছে।  যে হারে মামলা দায়ের হচ্ছে সে হারে নিষ্পত্তি কম।  বরং প্রতিদিন নতুন করে আরও যুক্ত হচ্ছে মামলা দায়েরের সংখ্যা।  ফলে মামলাজটের বোঝা দিনদিন আরও ভারি হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক তথ্য মতে, সারাদেশে উচ্চ ও অধস্তন আদালতে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ১৭ হাজার ৫৪৭ ও হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ১৮ হাজার ১টি।  একই সময়ে অধস্তন আদালতে ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫টি মামলা বিচারাধীন ছিল।  এর সাথে আরও নতুন নতুন মামলা যুক্ত হচ্ছে।

দেশের  অধস্তন আদালতেও প্রতিদিন যে হারে মামলা হচ্ছে, সেভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে না।  ফলে বেড়েই চলেছে মামলাজট।  গত বছরের অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে অধস্তন আদালতে গড়ে দিনে ৪ হাজার ১৫২টি মামলা হয়েছে।  বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ হাজার ৮১৬ মামলা।  অর্থাৎ দিনে গড়ে ৩৩৬টি নতুন মামলা অধস্তন আদালতের চলমান মামলাজটের সাথে যুক্ত হচ্ছে।

অধস্তন আদালতে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি-সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের আট বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আট বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।  প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কাছে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা অনুপাতে নিষ্পত্তির হার বাড়াতে আদালতে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারক নিয়োগ, বিদ্যমান আইন সংশোধনের পাশাপাশি বিচারাধীন মামলার তালিকা করে নির্ধারিত সময় বেঁধে দিয়ে নিষ্পত্তির বিষয় তদারকি করা ছাড়াও অহেতুক মামলা করার প্রবণতা কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।  এসব না হলে মামলাজটের হয়রানি থেকে বিচার বিভাগ কখনোই মুক্ত হবে না।

সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অধস্তন আদালতে গত জুন পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫টি মামলা বিচারাধীন।  সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫৪৮টি মামলা। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ১৭ হাজার ৫৪৭ ও হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ১৮ হাজার ১টি মামলা বিচারাধীন।  সব মিলিয়ে উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩টি।

সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়।  সে সময় উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার এবং অধস্তন আদালতে ১৫ লাখ ৭০ হাজার।  গত ১৫ বছরে আদালতে মামলাজট বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। বর্তমানে উচ্চ ও অধস্তন মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি বিচারক কর্মরত, যা মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির তুলনায় অপ্রতুল বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা বিভাগে, ২ লাখ ৬১ হাজার ৬২৬টি।  এর পরই চট্টগ্রামে ১ লাখ ৩২ হাজার ৫০৮টি।  তবে মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তিতে এগিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগ।

এ সময়ে ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৭ হাজার ৯০৪ মামলা দায়ের হলেও নিষ্পত্তি হয়েছে ৫১ হাজার ৮১১টি।  প্রায় ৩ হাজার ৯০৭টি পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যার গড় ১০৮ ভাগ।  সার্বিকভাবে মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির গড় ৯১ দশমিক ৯০, যা ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। যদিও ২০২১ সালে করোনার কারণে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি- দুটিই কম ছিল।  গত বছরের প্রথম ছয় মাসে মামলা হয় ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৮১টি।  আর নিষ্পত্তি হয় ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩১১টি।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেছেন, প্রধান বিচারপতি চলতি বছর দায়িত্ব নিয়েই মামলাজট নিরসনে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন।  অধস্তন আদালতে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির বিষয় তদারকির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের আট বিচারপতির নেতৃত্বে মনিটরিং কমিটি গঠন করেন।  কমিটি প্রধান বিচারপতির কাছে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাতে তদারকির কারণে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে।  এটি বিচারাঙ্গনের জন্য খুবই ইতিবাচক।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার বলেছেন, আইন সংশোধনসহ বিচারকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা ৬ লাখ মামলার জট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছি।  এ ক্ষেত্রে বিচারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।  মামলাজট কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি অনুপাতে আদালতে পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া দরকার।  আমরা সবাই সমস্যার কথা জানি।  কিন্তু সমাধানের বিষয়ে উদ্যোগ কম।  মামলাজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে।  বিচারপ্রার্থী জনগণের দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্যই এটি করতে হবে।