ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে বাংলাদেশ ও পরাশক্তিধর রাষ্ট্রের অবস্থান

সম্ভবত ভারতের সব রাজ্যে দুর্গা উৎসব হয় না; অবশ্য অঞ্চল ভেদে আচার-কৃষ্টির ভিন্নতা আছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ত্রিপুরায় ঐতিহ্যগতভাবে পালন করা হয় শারদীয় দুর্গা উৎসব। বাংলাদেশের সব জেলায় কমবেশ ঘটা করে দুর্গা উৎসব হয়। অবশ্য এবার পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে। ৩২,০০৮টি মন্ডপে শারদীয় উৎসব হয়। তবে আয়োজনে ব্যক্তি বিশেষ সামর্থের ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে, ইচ্ছে করলে যেনতেনভাবে শারদীয় দুর্গা উৎসব পালন করা যায় না; একসময় সরল ধর্মপ্রাণরা প্রতিকী রূপে এটি পালন করতেন। এখন আয়োজনে বর্ণাঢ্যতায় ছেয়ে গেছে। একেকটি মণ্ডপের ব্যয় অর্ধ কোটি টাকা ছেড়ে যায়। রীতিমতো চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠান-ক্রিয়াদি। তবে সামাজিকতার চাইতে রাজনীতিক অগ্রাধিকার পেয়ে বসেছে সবখানে। রীতিমতো রাজনীতির স্টার্নবাজি হয়। ‘দুর্গা দূর্গতি নাশিনি’।

দুর্গাকেও অতিকায় উজ্জ্বল-রশ্মি ছঁটাতে দেখা গেছে; তাঁর স্বরূপ তখনই বোঝা যায়, বেদনা-বিভোর এবং অশ্রু-সজল অন্তিম যাত্রা… । খুব কাছ থেকে এ দৃশ্য অবলোকন করা গেছে; সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যখন প্রতিমা দর্শনে বের হন, অর্থাৎ সদর পূজা মণ্ডপগুলোতে আরতি চলছিল, পূজারীরাও মন্ত্রপাঠে এবং তপবনে শঙ্খ- ঊলুধ্বনি ও পঞ্চানন প্রতিধ্বনি এবং কুণ্ডলি পাকানো ধূপধোঁয়ায় আচ্ছাদিত– তখন এক নবশুদ্ধ ব্রাহ্মণ এ দৃশ্য অবলোকন করেন! দৃশ্যত এমনই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে আকাশে ছোঁড়া বিধ্বংসি লাঞ্চারের অতিকায় লাভা, যেন একখণ্ড বেগুনি রশ্মির ঝলক; নির্বিচারে নিরস্ত্র ও বাস্তুহারা ফিলিস্তিন নারী-শিশুদের উপর টনে টনে বিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপ করে চলেছে। গগণজোড়া আর্তনাদ ফিলিস্তিন নারী-শিশুদের; দামোদর নরেদ্র মোদি সরকারও শেষদিকে এসে এটি বুঝতে পেরেছেন এ মানবিকতা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তিধর রাষ্ট্রটি প্রথমে হামাসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন এবং ইসরায়েলকে সমর্থন জানান। পশ্চিমাদের অতি আপন হতে গিয়ে ইসরায়েলদের প্রতি এ সমর্থন মোদী সরকারের। যদিওবা তাঁদের সমর্থন দেয়া না দেয়াতে কিছু আসে-যায় না; অনেকটা আগবাড়িয়ে দেয়া রাজনীতিকভাবে তাৎক্ষণিক এ নীতি অনেকের কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়।

এমনিতে দেশটির মণিপুর রাজ্যে ক্ষোভের আগুন দাউ দাউ জ্বলে। জ্বলেছিল শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও। কানাডার সরকারতো এ হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারত সরকারকে সরাসরি দায়ী করে। এ ঘটনায় শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। ভারতে প্রায় আড়াই কোটি শিখ বসবাস করে আসছে। বিশেষ করে পশ্চিম খাইবার পাস, উত্তর কাশ্মীর, দক্ষিণ সিন্ধু এবং দক্ষিণে মিঠাকোট পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনিতে খাইবার পাস নিয়ে চীনের সাথে চির সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। আপাতত চীন পশ্চিমা শক্তিকে ঠেকাতে একাট্টা এবং তাইওয়ান নিয়ে সর্তক অবস্থানে রয়েছে। ভারতের সীমান্ত লাগোয়া খাইবার পাস নিয়ে তাদের তেমন একটা মাতামাতি নেই। তবে, এ ক্ষেত্রে চীনে ক্ষাণিকটা উষ্কে যেতে পারে অশান্তির দানা; অবশ্য তাঁরা ওই নীতিতে নেই। তার সাথে প্রায় ১৮ কোটি মুসলিম, যা ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠি। তারাও যেন শান্ত থাকে; অন্যথায় কয়েকটি রাজ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে পারে মধ্যে প্রাচ্যের ফিলিস্তিনিদের ইস্যু নিয়ে। মোদী সরকার যেখানে নিজ ঘর সামলাতে উষ্ঠা যাওয়া অবস্থা। জি-২০ সম্মেলন শেষে এমন প্রতিক্রিয়া তাঁরা হাতে হাতে দেখতে পায়!
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্মেলন শেষে ফেরার পথে ভিয়েতনামে গিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ভারতে সংখ্যালঘ্যুদের উপর দমন-পীড়ন বেড়েছে; সব মিলে ভারতে অসহিষ্ণুতার কালো থাবা। ইতিমধ্যে শিখ গুরু নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কানাডা ভারত থেকে ৪১ কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে। তবে এসব ঘটনার পর একটু হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভারত সরকার। তাঁরা মিউজিকের মত অনেকটা রূপ পাল্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকার ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের দ্বন্দ্বে ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকে নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশও তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে, বাংলাদেশ ফিলিস্তিনদের পক্ষে ভোট দেয়। এছাড়া জাতিয় সংসদে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনায় শোক জানায়। ২২/১০/২৩ইং স্পিকার ড. শিরীণ শারমিন চৌধুরীর উত্থাপিত এ সংক্রান্ত শোক প্রস্তাব সংসদে গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলেছেন, ওআইসি সম্মেলন ডেকে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনদের ওপর এমন বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় ইসরায়েল সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা প্রস্তাব আনা হবে।

কিন্তু নেতানিয়াহু সরকারের একের পর এক বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ইহুদী জাতিকেও বিষিয়ে তুলেছে। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান একনায়ক এডলফ হিটলার প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদী হত্যা করে। এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞে বিশ্ববাসী ধিক্কার জানায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো তখন কি ইহুদী জাতিকে নির্বিচারে হত্যা করার কোন যৌক্তিকতা ছিলো? মানুষের সহমর্মিতার জায়গায় নেতানিয়াহু সরকার আঘাত হেনেছে। নতুন করে আবারও বিতর্কের জন্ম দেয়। ইহুদী জাতিকে একঘরে কোনঠাসায় উপনীত করে তুলেছে। ইহুদীদের অর্জন-আবিষ্কার, ব্যবসা- বাণিজ্যসহ সবই ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকবে এ জাতি।

তারা ফিলিস্তিনের মাতৃভূমি গাজা উপত্যকা দখলের মানসে এমন প্রভাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে- নির্দিষ্ট চক এ্যঁকে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালাচ্ছে। নজির বিহীন এ হামলার ঘটনায় বিশ্বও স্তম্ভিত। শুরু হয়েছে দেশে দেশে মুক্তিকামী জনতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। একই সঙ্গে শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ ইহুদীরাও প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেন। তাঁরাও দাবী তুলেন, অবিলম্বে গাজায় নিরীহ মানুষের উপর হামলা বন্ধ করে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি ছেড়ে দেয়ার। তবে পরাশক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নীতি নিয়েও জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমেরিকা দখলদার ইসরায়েলকে শুধু রণতরী দিয়ে সহযোগিতা করছে না, এবার অর্থ দিয়েও সাহায্য করতে চায়।
বৃহস্পতিবার রাতে ওভাল অফিসে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ ঘোষণা দেন। তিনি কংগ্রেসের কাছে একটি জরুরি তহবিলের অনুরোধ পাঠাবেন, যা আগামী বছরের জন্য ১০ হাজার কোটি ডলার হবে বলে আশা করেন। আল জাজিরার প্রতিবেদক অ্যালান ফিশার জানান, ইসরায়েলের জন্য ১৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ চাইতে পারেন জো বাইডেন। বাইডেন আরো বলেন, আমেরিকার নিরাপত্তা বিবেচনায়, এটি একটি স্মার্ট বিনিয়োগ, যার লভ্যাংশ ভোগ করবে আগামী প্রজন্ম। যুদ্ধের মত মানবিক বিপর্যয় থেকে লভ্যাংশ আশা করা এবং প্রজন্মদের উৎসাহ দেয়ার বিষয়টিও ভাবিয়ে তোলে। অথচ বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরি করে সবক দিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার এ নীতিতে আরো স্পষ্ট হয় যে পারস্য উপসাগরে তাদের উপস্থিতি দীর্ঘ হবে। তারা শুধু গাজা উপত্যকাবাসী ফিলিস্তিনিদের উৎখাতে নামে নি, পারস্য উপসাগরে বাণিজ্যও বিস্তৃত করতে চায়। জ্বালানিসহ খনিজ সম্পদে তাদের ভ্রুক্ষেপ। অর্থাৎ ডলার সহ একচ্ছত্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ রাখা। এর মধ্যে সৌদি আরবের সাথে সমন্বয় করে এ অভিযান ফলপ্রসু করতে চেয়েছিল আমেরিকা। যার ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টিন ব্লিনকেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে ছুটে যান। সে হালেও পার পাননি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যা কিনা একদিন পরে বৈঠক হলেও পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যুবরাজ গাজা উপত্যকায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিন মুসলিমদের উপর হত্যাযজ্ঞ কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। এ হামলা বন্ধ করাসহ পারস্য উপসাগর থেকে সকল রণতরী সরিয়ে নিতে বলেন। এছাড়া সিরিয়া ও ইরান পথের কাটা হলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীন। অবশ্য এর মধ্যে চীন ও রাশিয়া তাদের রণতরী ভাসিয়েছে পারস্য উপসাগরের উদ্দেশ্য। ইরানও তাদের রণতরীর অবস্থান আরো জোরদার করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি গণমাধ্যমে ভাষণে বলেন, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল যুদ্ধ অবস্থা থামাতে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমধান করতে হবে। অবশ্য দু’পক্ষকে জাতিসংঘের প্রস্তাব মানতে হবে।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কবি ও কলাম লেখক।