খুব কম সংখ্যক মানুষ নিজের চলার পথ নিজেই তৈরি করেন। এই কম সংখ্যক মানুষের মধ্যে অনন্য উদাহরণ হয়ে টেকনোখাতকে আলোকিত করে আছেন টেকনো মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. যশোদা জীবন দেবনাথ। সম্প্রতি ফ্রান্সের বিখ্যাত দ্য থেমাস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট অব লিটারেচার (ডি.লিট) উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন ড. যশোদা জীবন দেবনাথ। এছাড়াও একাধারে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী, লেখক, ব্যবস্থাপক, সমাজসেবক, সিআইপি, বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক এবং এফবিসিসিআই-এর সহ-সভাপতি। তার সাথে কথা বলেছেন দেশ বর্তমানের বিশেষ প্রতিবেদক সাজেদা হক
স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে হলে, সকলের জন্য একটাই ‘স্মার্ট সিকিউরিটি কার্ড’ থাকা উচিৎ বলে মনে করেন ড. যশোদা জীবন দেবনাথ। তিনি বলেন, বিশে^র বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আমরা একটাই ইউনিক স্মার্ট কার্ড দেখি। যে কার্ডটি একটি শিশুর জন্ম থেকে বড় হওয়া, বেড়ে ওঠা এবং মৃত্যু পর্যন্ত ব্যবহার করে। তার স্কুলিং, ফুডিং, যাতায়াত, ডেইলি ইউজেজ, লাক্সারি কিংবা স্যালারী, সেভিংস সব কিছুর তথ্য ওই এক কার্ডেই থাকে। ফলে তার আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠে না, দেশও তাকে তার করা সঞ্চয় থেকেই রিটার্ন দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ এখন আর আগের মতো দরিদ্র দেশ নেই। এটি এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। সুতরাং শুধু উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লেখালেই হবে না, আমাদের প্রত্যেককে উন্নত নাগরিক হয়ে উঠতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক। এজন্য টপ টু বটম আমাদের ডিজিটাল হতে হবে, হতে হবে স্মার্ট এবং আধুনিক। এজন্য আমাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব হতে হবে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক। আর এজন্য প্রত্যেকের জন্য আমাদের এখন একটি ইউনিক কার্ড তৈরি করা জরুরি। বাংলাদেশের জন্য এটিই হবে এখন স্মার্ট উদ্যোগ এবং বিনিয়োগ। এই কার্ডের সাথে এনআইডি কার্ড, একটা মাস্টার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার, টিন নম্বর-সবই এই এক কার্ডেই সমন্বয় করা সম্ভব। আর এই কাজটি করা খুব সহজ।
এই যে নতুন একটি প্রকল্প চালু হলো, সার্বজনীন পেনশন স্কিম। এখানে সবার ডাটা আছে। এই ডাটাকেও আমরা এই একই কাজে ব্যবহার করতে পারি। আমি মনে করি এমন একটা ইউনিক কার্ড যদি বাংলাদেশ শুরু করতে পারে, তাহলে ট্যাক্স সরাসরি রাজস্বখাতে জমা হবে। হ্যাঁ, সঞ্চয় এবং কর দেয়ার পরিমাণকে বিবেচনায় রেখে সরকার এই কার্ডের ‘শ্রেণী’ তৈরি করতে পারে। এই ইউনিক কার্ড নিয়ে আলোচনা, মতামত, পরামর্শ শুরু হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। সার্বজনীন পেনশন স্কিমকে কিন্তু ম্যানুয়ালী রাখা হয়েছে। এটাকেও ডিজিটালাইজ করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশগুলো এভাবেই চলছে। আর এমনটা যদি করতে পারি আমরা তাহলেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিক দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যাবে। ক্যাশলেস স্মার্ট নাগরিকরাই হতে পারে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তৈরির স্মার্ট হাতিয়ার। সুতরাং এটি শুধু আমার দাবি না, সময়েরও দাবি।
টেকনো মিডিয়া তার কার্যক্রম ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। হাইটেক পার্কে ইন্ডাস্ট্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে টেকনো মিডিয়া। এখানে আমরা লোকালি এটিএম মেশিনগুলো রিএসব্লিং করবো। চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং করা হবে। এই প্রযুক্তিভিত্তিক ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে তোলাই টেকনো মিডিয়ার লক্ষ্য। আমি মনে করি বাংলাদেশে এটিএম বুথ অপ্রতুল, এই সেবাকে প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা। প্রত্যেকটা মানুষ যেনো ব্যাংকিং চ্যানেলে আওতায় চলে আসে। এজন্য ২৪ ঘন্টা ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। শুধু এটিএম বুথই নয়, আজকে ৬ কোটি মানুষ বিকাশের গ্রাহক, ৫ কোটি মানুষ নগদের গ্রাহক। এইটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। হংকংয়ের উদাহরণই যদি দেই আপনাকে, আপনি জানবেন যে, সেখানে অক্টোপাস নামে একটাই কার্ড ব্যবহার করে সকল নাগরিক। মুদি দোকানের বাজার থেকে, যাতায়াত, খাবারসহ সব লেন-দেন হয় ওই অক্টোপাস কার্ডের মাধ্যমে। অথচ আমাদের দেশেও কার্ড সিস্টেম তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা অত্যন্ত সীমিত। গ্রামে গেলে বুথ পাওয়া যায় না। ফলে আধেক ক্যাশ আর আর আধেক ক্যাশলেস নাগরিক আমরা। আমরা এই এক দেশের জন্য এক কার্ড তৈরি করতে চাই। আর এর মধ্য দিয়ে দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করার ইচ্ছা পোষণ করি। এজন্য আসলে কোন বাধা নেই। বরং সদিচ্ছা প্রয়োজন। ধরেন আপনি একটা ব্যাংকে গেলেন, চেক দিয়ে টাকা তুলবেন। যদি ১০০ টাকাও তোলেন, আপনাকে সেই ১০০ টাকা দিতে ব্যাংকের খরচ হবে ১০০ টাকা। অথচ আপনি যদি সেই ১০০ টাকা অনলাইন নেন, তাহলে খরচ হবে মাত্র ২০ টাকা। তাহলে বলেন, যেখানে ২০ টাকায় সমস্যার সমাধান হয় তাহলে কেন একজন গ্রাহক ৮০ টাকা খরচ করবে? আপনার জীবন যাত্রা এমনভাবে তৈরি করতে হবে। আপনার ব্যাংকিং আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দিতে হবে। আর এই কাজটাই আমি করতে চাই।
বিশে^ ডব্লিওটিও এর মেম্বার রাষ্ট্রগুলোর সাথে একটা চুক্তি আছে। আইটি এন্ড আইটি এনাবল সার্ভিসেস চুক্তি মোতাবেক এক দেশ থেকে চুক্তিভুক্ত অন্য দেশে আইটির খুচরা যন্ত্রাংশ বা উপকরণ নিতে কোন ডিউটি (শুল্ক) ফ্রি হওয়ার কথা, কিন্তু আমাদের দেশে ডিউটি ফ্রি না। বরং আলাদা করে কর দিতে হয়। প্রশ্ন হলো কেন দিতে হবে? আমি মনে করি এই বিষয়টায় সরকারের মনোযোগ দিতে হবে। ফ্রি করে দিতে হবে ব্যবসায়ীদের জন্য, বিশেষ করে আইটি এন্ড আইটি প্রডাক্টের ক্ষেত্রে। সাফটা এগ্রিমেন্ট্রের আলোকে ট্রেড এক্সচেঞ্জ করতে হবে। ট্রেড ভারসাম্য নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। কারণ আমরা ট্রেডে ভারসাম্য রক্ষা করছি না। ভারতের কাছ থেকে আমরা আনি ২ বিলিয়ন ডলার নিয়ে আসি, কিন্তু তারা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। এই যে ট্রেড ভারসাম্যহীনতা এটার পরিবর্তন চাই আমরা ব্যবসায়ীরা। আমরা কালচারাল এক্সচেঞ্জ চাই। টিভি খুললেই আমরা ভারতীয় সব চ্যানেল দেখতে পাই, কিন্তু ভারতে গেলে দেখেন বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে পাবেন না-কেন দেখা যাবে না বলেন তো? এজন্য যে ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনশিপ মেইনটেইন করতে হয় তা করা উচিৎ। পলিটিক্যাল লোকদের এসব দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। কালচারাল এক্সচেঞ্জগুলো যদি আমাদের চারপাশের দেশগুলোর সাথেই গড়ে ওঠে তাহলে কিন্তু হয়। এটা না হলে, আমাদের কাছ থেকে অন্যদেশগুলো ভালো পন্য নেবে, বিনিময়ে আমরা ঠিক সেই পরিমান প্রতিদান পাবো না।
স্মার্ট নেতৃত্ব প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. যশোদা জীবন দেবনাথ। তিনি বলেন, রাজনীতির সাথে ব্যবসা এবং ব্যবসার সাথে রাজনীতি পরস্পরের সাথে ভীষনভাবে যুক্ত। তাই সৃজনশীল বা ক্রিয়েটিভ ব্যবসায়িদের রাজনীতিতে আসা অত্যন্ত জরুরি। কেবল তারাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে পারে। এজন্য আমাদের খুব সচেতনভাবে স্মার্ট, ক্রিয়েটিভ এবং সচেতন ব্যবসায়িদের বেছে বেছে রাজনীতিতে যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেখেছেন, সেই সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষই প্রয়োজন। সত্যিকারের দেশ গড়ার জন্য ক্লিন ইমেজের মানুষ দরকার। ক্লিন ইমেজের মানুষ যদি রাজনীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে রাজনীতির পরিবেশটাই বদলে যাবে। ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষকে রাজনীতিতে যুক্ত করতে হবে। সমাজ পরিবর্তন করতে চাইলে এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন করতে চাইলে অবশ্যই ক্লিন ইমেজের ব্যবসায়ীদের যুক্ত করতে হবে বলে আমি মনে করি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে অনেক দিয়েছেন, তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। তিনি আমাকে সিআইপি বানিয়েছেন, এফবিসিসিআই, ব্যাংক, বীমার পরিচালক বানিয়েছেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ে যুক্ত করেছেন। সুতরাং আমি ওনার কাছ থেকে অনেক পেয়েছি। তবে তিনি যদি মনে করেন আমাকে জনসেবা করার সুযোগ দেবেন তাহলে দায়িত্ব মাথা পেতে নেবো। আর যদি বলেন, অন্যের হয়ে কাজ করতে, আমি তাও করতে রাজি আছি। আমার বিশ^াস, উনি অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং একজন দূরদশী নেতা। তিনি ভুল কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। কারণ তার কাছে কোন জিনিস চাওয়া লাগে নাই আমার, চাওয়ার আগেই সব দিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমার আরেকটি লক্ষ্য হলো ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরি করা। আমি মনে করি যে, ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরি করতে পারলেই দেশে অবৈধ আয় বা লেন-দেন কমে যাবে। আপনি যখনি কোন অফিসারকে ঘুষ দেন তখন তিনি তা নেন ক্যাশে। এই ক্যাশটাই যদি না থাকে তাহলে আপনাকে বাধ্য হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে ট্রান্সজেকশন করতে হবে। বছর শেষে যখন আপনি ট্যাক্স ফাইলটা জমা দেবেন তখন কিন্তু হিসেবটা অটোমেটিকভাবেই হয়ে থাকবে। ই-কমার্সের মাধ্যমে মাত্র ৮-৯% লেন-দেন হয়, বাকীটা কিন্তু ক্যাশেই লেন-দেন চলে। সুতরাং এটাকে ৮০-৯০% লেনদেন ই-ক্যাশে নিয়ে যেতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের অঙ্গীকার তখনি পূর্ণতা পাবে। তিনি বলেন, এটা সত্য যে, বাংলাদেশ একটা ছোট দেশ। এখানেও যদি লং টার্ম প্লান করা যায় তাহলে এই দেশের মানুষ দরিদ্র থাকবে না। বাংলাদেশের বাজেট এখন ৭ লাখ কোটি টাকার মতো। এর ৮২% দেয় কিন্তু ব্যবসায়ীরা। তো এই ব্যবসায়ীদের লেন-দেনও স্মার্ট হওয়াতে হবে। তাহলেই দেশের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। অথচ এই বাজেট ২০০৪ সালের দিকে ছিলো মাত্র ৮৬ হাজার কোটি টাকা মাত্র।
আমরা এফবিসিসিআই-এর ব্যবসায়ীরা পরিকল্পনা করছি যে, আমাদের আয় ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য আমাদের গতানুগতিক চিন্তাধারার বাইরে এসে ব্যবসায়িক চিন্তা করতে হবে, তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আয়ের খাত কিন্তু আরএমজি সেক্টর অর্থ্যাৎ গার্মেন্টস খাত। এ বছর এ খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৬০ বিলিয়ন ডলার, এরমধ্যে কিন্তু তারা প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে ফেলেছেন। আগামীতে আমাদের টার্গেট হলো তথ্য ও প্রযুক্তি খাত। এজন্য যুক্ত করতে হবে ইয়াং জেনারেশনকে। পথ দেখাতে হবে। ইতোমধ্যে তারা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মধ্যদিয়ে আয় করা শুরু করে দিয়েছে। ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়ে আয় করছেন অনেকে। যে কাজটা তরুনরা ভালো বোঝে, তাদেরকে সেই কাজেই যুক্ত করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুনরা কিন্তু খুব একটা কাজে আসছেন না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষা খাতের আমুল পরিবর্তন আনা জরুরি বলেও তিনি মনে করেন। কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তত পক্ষে এসএসসি লেবেল থেকেই কারিগরি শিক্ষা যুক্ত করা উচিৎ বলেও মনে করেন চারবারের সিআইপি পদক প্রাপ্ত ড. যশোদা জীবন দেবনাথ।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিশ্ব ছিলো অসহায়। এই ভাইরাসের থাবায় অনেক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কিছু ফ্যাক্টরি কল-কারখানা চালু থাকলেও অনেক মালিকরা শ্রমিকের বেতন দিতে হিমশিম খেয়েছে। আবার অনেকে কর্মীদের বেতন কমিয়েছেন এমনকি কর্মী ছাটাইয়ের মত ঘটনাও ঘটছে। অথচ এই করোনা মহামারির শুরু থেকে কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। কর্মীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধিসহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা কর্মীদের প্রদান করেছি।