বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি। উৎসবের আবীর রঙে রঙিন হয় বাঙালির মন ও মনন। বলা হয়ে থাকে বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ বাংলাদেশ। এখানে, এই জনপদে সারা বছর উৎসব লেগেই থাকে। সামাজিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে উৎসব পালন করা হয়। ‘উৎসব কী’ এ সম্পর্কে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ ‘মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেদিন তার উৎসব। সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হয়ে হয় বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করে হয় মহৎ।’
বৃহৎ মনের অধিকারী মানুষ তাই তার আনন্দকে নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, সকলের সাথে মিলেমিশে পেতেই বেশি কামনা করে। বাঙালি তাই পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি, নবান্ন, ঈদ-পূজা, পিঠা উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, বাউল উৎসব ইত্যাদি উৎসব পালন করে। এতসব উৎসবের সাথে আর একটি উৎসব সারা দেশে বর্ণিল আনন্দে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই উৎসব হলো ‘বই উৎসব’। বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ১লা জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়। এই দিনটি তাই সারাদেশে বই উৎসব নামে দারুণ ভাবে সমাদৃত। বাংলাদেশে ২০১০ সালের ১ লা জানুয়ারি প্রথমবার বই উৎসব পালন করা হয়। তারপর থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছরের প্রথম দিন সারা দেশ ব্যাপী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই উৎসব পালন করা হয়।
বিনামূল্যে বিপুল সংখ্যক বই বিতরণ করে বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সর্ব মোট ৪৩৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২১১ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে, বিনা ব্যর্থতায় শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা। সক্ষমতার মাপকাঠিতে যা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ যা করার শাহস করতে পারেনি, তাই করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
নতুন বই হাতে পাবার যে আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শিশু যখন নতুন বই হাতে পায় তখন তার চোখে মুখে যে আনন্দের ঝিলিক তা সত্যিই বড়ো মনোমুগ্ধকর। নতুন বইয়ের মিষ্টি ঘ্রাণে বিমুগ্ধ খুশির ঢেউ খেলে যায় শিশুর কোমল মনে।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে ব্যপক আয়োজনের মাধ্যমে বছরের প্রথম দিনই পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেয়া হয়, একসময় তা কল্পনা ও করা যেতো না। আগে এমনও হতো বছরের অর্ধেক সময় চলে যেতো নতুন বই পেতে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ সরকারের তথা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। বাংলাদেশ, সম্পদের স্বল্পতাসহ নানান সমস্যা থাকা সত্বেও বিনামূল্যে সকল বই বিতরণের এই মহৎ কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন উপকরণ হল বই। বই ছাড়া শ্রেণি কার্যক্রম তথা জ্ঞান দান করা অসম্ভব। বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যা সংক্ষেপে ঘঈঞই নামে পরিচিত। শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল বিষয়ের বই প্রণয়ন তাদের মূল কাজ। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রসারে বৃহৎ জাতীয় প্রতিষ্ঠান এই ঘঈঞই ব্রিটিশ আমলের টেক্সট বুক কমিটি, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গ স্কুল টেক্সট বুক কমিটি, ১৯৫৪ সালের টেক্সট বুক আইন পাশের মাধ্যমে স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সময়ের পরিক্রমায় ১৯৮৩ সালে ঞযব ঘধঃরড়হধষ ঈঁৎৎরপঁষঁস ধহফ ঞবীঃনড়ড়শ ইড়ধৎফ ঙৎফরহধহপব -১৯৮৩ পাশের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিশেষে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পূর্বের আইনটি সংশোধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন-২০১৮’ বিল মহান জাতীয় সংসদে পাশ হয়। পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, পরিমার্জন, প্রকাশ এবং বিতরণের দুরূহ কাজটি করে আসছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো নির্বাচন করা হয়। তাছাড়া বইয়ের ভেতরে ব্যবহৃত চিত্রকল্প যেন আকর্ষণীয় ও শিক্ষনীয় হয় সেদিকে গভীরভাবে খেয়াল রাখতে হয়।কোমলমতি শিক্ষার্থীর হাতে আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ ও ঝকঝকে মুদ্রিত বই, তাদের আনন্দের মাত্রা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে দেয়। একটি বই শিশুর আগামী দিনের নতুন স্বপ্নের সেতু হিসেবে কাজ করে।
নতুন বইয়ের পাতায় পাতায় শিশুর কাছে আগামীর বিশ্ব মূর্তমান বিস্ময় হয়ে ধরা দেয়। বিস্ময় বিভূঁইয়ে ডুবে এই শিশুটি যেনো নিজেকে নতুন পৃথিবীর যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করতে পারে, এদিকে পাঠ্য পুস্তক প্রণেতাদের সুদৃষ্টি রাখতে হবে। নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী সমৃদ্ধ শিশুর মানস গঠনে পাঠ্য পুস্তকের ভূমিকা অশেষ। শিশু পারিবারিক পরিসর থেকে নৈতিক মূল্য বোধের মৌলিক শিক্ষা লাভ করে। মা-বাবা, পরিবেশ প্রতিজনদের দেখে দেখে তার আচরণ বিধি গড়ে উঠে। তারপর শিশু তার শিক্ষক তথা বিদ্যালয় থেকে জীবনের নানা দিকের পাঠ নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার্থীকে শুধু জীবনের প্রয়োজনীয় বৈষয়িক জ্ঞান দান করলেইএকজন প্রকৃত শিক্ষকের কাজ শেষ হয়ে যায়না, তাকে চারিত্রিক, নৈতিক, ভালো-মন্দ বুঝতে পারার শিক্ষায় ও শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বর্তমান যান্ত্রিক, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মানবিক শিক্ষার গুরুত্ব অসীম। শিক্ষার্থীদের শুধু ক্যারিয়ারের মরীচিকার পিছনে না ধাবিত করে, তার ভেতরকার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে অবদান রাখবে শিক্ষক তথা পাঠ্য পুস্তক। আজকের যুব সমাজের নৈতিক স্খলন দেখে ভয়ে শিউরে ওঠতে হয়। এই বিমুখ আর ডিভাইস আসক্ত যুব সমাজ দিয়ে কাঙ্খিত দেশ ও জাতি গঠন করা অসম্ভব।
পৃথিবী নামক এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ ফুল হলো শিশু। বাংলাদেশের অগণিত ফুল শিশু নতুন পাঠ্য পুস্তক হাতে পাবার অধীর আগ্রহে দিন গুনছে। কিন্তু পৃথিবীর কিছু দেশে এই শিশু ফুলগুলো ভালো নেই। দানব কতক মানুষের পাশবিক কর্মতৎপরতায় অকালেই ঝরে পড়ছে হাজার হাজার ফুল। তেমনি এক দেশ ফিলিস্তিন। দানবীয় ইজরায়েল যেখানে শত ফুল বিকশিত হবার আগেই ধ্বংস করে দিচ্ছে সাজানো বাগান। গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েল কর্তৃক গাজায় হামলার আজ ৮২ তম দিনে নিহতের সংখ্যা ২১,০০০ এর উপর। যার মধ্যে ৪,০০০ বেশি শিক্ষার্থী। বাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত মালিরুপ শিক্ষক নিহতের সংখ্যা ২০৯ জন। গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইজরায়েলের হামলায় গাজায় ৩৫২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। অকালে ঝরে যাওয়া এই ফুলগুলো হতে পারতো সুন্দর পৃথিবীর শুদ্ধতম প্রাণ। পৃথিবীর সব ফুল সুন্দর পরিচর্যায় বিকশিত হোক এটাই কাম্য। শহরের ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, ঘাটের পাশে জীর্ণ পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা পথশিশুরাও সুন্দর ও ভালোবাসাময় পৃথিবীতে বেড়ে উঠুক। বই উৎসবের অংশীদার হয়ে, নতুন বইয়ের মিষ্টি ঘ্রাণে তাদের জীবন ও সুভাষিত হবে এটাই আমাদের চাওয়া।
শিক্ষা এখন আর কোনো সুযোগ নয়। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে শিক্ষার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রকে একই পদ্ধতির গণমূখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৯০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার ছিলো ৬১%, কিন্তু বর্তমানে প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ তথা বই উৎসব এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আমাদের উৎসবের চিরন্তনতায় বই উৎসব বয়ে আনুক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। বই উৎসব হোক ছোট সোনামণিদের জন্য নববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।