আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এমডির বিশাল সিন্ডিকেট, অভিযোগ দিলেই দেখান চাকরিচ্যুতির ভয়

চট্টগ্রাম ওয়াসা

দুর্নীতি ও অনিয়মের পর এবার স্বজনপ্রীতির কারখানায় পরিনত হয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এরই ফলপ্রসূ প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায় চট্টগ্রাম ওয়াসাকে। এই সকল অনিয়ম-দুর্নীতির একচ্ছত্র রাজা চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ খোদ নিজেই।

প্রকল্পে দুর্নীতি, অর্থ কেলেঙ্কারী, নথি পুড়িয়ে ফেলা- কি করেননি তিনি! নিয়োগ বাণিজ্যে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে তৈরি করেছেন বিশাল এক সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে উল্টো সেই কর্মকর্তা-কর্মচারীকে করেন হয়রানি, দেখান চাকরিচ্যুত করার ভয়। এছাড়াও নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় নিজের আত্মীয়-স্বজন ও সিন্ডিকেট সদস্যদের।

চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহর এই সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে নিজেরই ২০ জনের অধিক নিকট আত্মীয়। এছাড়াও রয়েছে নিজ এলাকা নোয়াখালীর অন্তত আরও ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, জ্যৈষ্ঠতা ভেঙে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিজের আত্মীয়-স্বজনকে প্রকল্পের পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব দিয়েছেন এমডি এ.কে.এম. ফজলুল্লাহ।

এ.কে.এম. ফজলুল্লাহ ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদ থেকে অবসর নেন ১৯৯৮ সালে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান তৎকালীন চেয়ারম্যান এ.কে.এম ফজলুল্লাহ।

টানা ৮ মেয়াদে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বে আছেন তিনি। এতো বছর ক্ষমতায় থাকার পর এখন যেন সব অনিয়মই তার কাছে নিয়ম। তার বির্তকিত কর্মকান্ডে বিব্রত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমডি’র আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে শুরুতেই রয়েছেন রওনক জাহান নামে তার এক ভাগনি। যিনি কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ এ চুক্তিভিত্তিক হিসাবরক্ষক পদে নিয়োজিত ছিলেন। তবে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এখনও একই পদে বহাল আছেন তিনি। এছাড়াও রওনকের স্বামী সম্পর্কে এমডি’র ভাগনি জামাই আবু নোমান সিদ্দিকী আছেন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে। তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে বেশকিছু অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ।

এছাড়াও এমডি’র আত্মীয়ের তালিকায় আছেন নাতনি লুৎফি জাহান। আছের নাতনি জামাই শফিকুল বাসারও।

এমডির ভাগনে আবু ইউসুফ কর্মরত আছেন বিক্রয় বিভাগের সহকারী প্লাম্বিং মিস্ত্রি হিসেবে। আরেক ভাগনি আফসানা নুর আছেন হিসাব সহকারী পদে। এমডি’র ভাতিজা মোহাম্মদ আলী আছেন ভান্ডার শাখায় কম্পিউটার অপারেটর পদে। আরেক ভাতিজা ইমরান খান আছেন মোহরা পানি শোধনাগারে উপ-সহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্বে। ভাতিজি মেহেরুননেছা পপি আছেন মড-১ শাখায় উপ সহকারী প্রকৌশলী পদে। এমডির তালতো বোন আয়েশা হোসেন আছেন রাজস্ব তত্ত্বাবধায়ক পদে।

জানা গেছে, আউটসোর্সিংয়ে চাকরি করেন এমডির আত্মীয় আরও অন্তত ১৫ জন। শুধু চাকরি নয়, ঠিকাদারীতেও বিস্তৃত এমডি’র আত্মীয়দের শিকড়। দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার পাস নিজের আত্মীয়দের হাতে, নেন মোটা অঙ্কেও কমিশনও।
তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির উত্থাপিত অভিযোগ উচ্চ আদালত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছে। তবে তদন্তের ওই আদেশ উচ্চ আদালতের বারান্দা পর্যন্তই সীমিত। অজ্ঞাত কোনো এক কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন উচ্চ আদালতে দাখিল করেনি।

এছাড়াও এই অকুতভয় রাজা ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে অর্থপাচার, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে বলে আদালতকে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

২০২৩ সালের অক্টোবরে তার সাতবারের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি’র দায়িত্ব পেলেন।

পদত্যাগ, অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, আমাকে সরকার এ পদে বসিয়েছে। সরকার যেদিন আমাকে বলবেন- আমি তখনই পদত্যাগ করবো। তবে অনিয়মের বিষয়ে তিনি কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেননি।