আজ পবিত্র হজ
‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ানিনমাতা লাকা ওয়ালমুল্ক লা শারিকা লাক’ ধ্বনি-মধুধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে পবিত্র আরাফাতের পাহাড়-ঘেরা ময়দান ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস মুখর ও প্রকম্পিত আজ। সুউচ্চকণ্ঠ নিনাদের তালবিয়ায় মহান আল্লাহ তায়ালার একত্ব ও মহত্ত্বের কথা বিঘোষিত হচ্ছে প্রতি অনুক্ষণ। ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা ও নিয়ামত তোমার এবং রাজত্বও, তোমার কোনো শরিক নেই।’
আজ মঙ্গলবার বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন পবিত্র হজ। আরাফার আদিগন্ত মরুপ্রান্তর এক অলৌকিক পুণ্যময় শুভ্রতায় ভরে উঠেছে। সফেদ-শুভ্র দুই খণ্ড কাপড়ের এহরাম পরিহিত হাজিদের অবস্থানের কারণে সাদা আর সাদায় একাকার। পাপমুক্তি আর আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এই পবিত্র হজ পালন করছেন। আজ ফজরের পর গোটা দুনিয়া থেকে আগত ২৬ লক্ষাধিক মুসলমান ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন।
এ বছর হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে রোববার। সোমবার রাতও পবিত্র মিনায় অতিবাহিত করেন হজযাত্রীরা।
সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইতিহাসে এবারই (২০২৩ সালে) সবচেয়ে বেশি হাজির পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে কাবা প্রাঙ্গণ। কাবা ঘর প্রদক্ষিণ করেছেন বিশ্বের ১৬০টি দেশ থেকে আসা লাখ লাখ হাজি।
ইতিহাসের সবচেড়ে বড় হজ হওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এ বছর, আমরা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হজ প্রত্যক্ষ করছি।
আল আরাবিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। হাজিরা ফজরের নামাজের পর মিনার উদ্দেশে যাত্রার মধ্য দিয়ে হজের কার্যক্রম শুরু করেন। আর শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে আগামী ১২ জিলহজ এই আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।
সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের ভালোভাবে বিশ্রামে থাকা নিশ্চিত করতে মিনা এলাকায় হাজার হাজার তাঁবু স্থাপন করেছে। এখানে অবস্থানকালে হজযাত্রীরা সারারাত কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ আদায় করছেন।
মূলত তাঁবুর শহর নামে পরিচিত মিনা প্রান্তরে পৌঁছানোর মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। আজ ৯ জিলহজ মূল হজের দিন তারা আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকবেন। চার বর্গমাইল আয়তনের এই বিশাল সমতল মাঠের দক্ষিণ দিকে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড, উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে আরো প্রায় পৌনে ১ মাইল বিস্তৃত। মুসলমানদের অতি পবিত্র এই ভূমিতে যার যার মতো সুবিধাজনক জায়গা বেছে নিয়ে তারা ইবাদত করবেন; হজের খুতবা শুনবেন এবং জোহর ও আসরের নামাজ পড়বেন। আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরায় জোহরের নামাজের আগে খুতবা পাঠ করবেন গ্র্যান্ড ইমাম। সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে আল্লাহ তায়ালার জিকির-আসকার ইবাদতে দোয়ায় মশগুল থাকবেন। অতঃপর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফার ময়দান ত্যাগ করবেন এবং মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ এশার ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সমস্ত রাত অবস্থান করবেন। মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি কংকর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন।
মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। ১০ জিলহজ মিনায় পৌঁছার পর হাজিদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমে মিনাকে ডান দিকে রেখে হাজিরা দাঁড়িয়ে শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ করবেন। দ্বিতীয় কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা। অনেকেই মিনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন। তৃতীয় পর্বে মাথা ন্যাড়া করা। চতুর্থ কাজ তাওয়াফে জিয়ারত।
প্রথম দিন মিনায় পৌঁছে বড় শয়তানকে সাতটি কংকর নিক্ষেপ, মাথা মুণ্ডন ও কোরবানি দিয়ে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মেতে উঠবেন ঈদের আনন্দে।
জিলহজের ১১ তারিখ মিনায় রাতযাপন করে দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হাজিরা বড়, মধ্যম ও ছোট শয়তানের ওপর সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করবেন। আর এ কাজটি করা সুন্নত। পরদিন ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে পুনরায় একইভাবে হাজিরা তিনটি শয়তানের ওপর পাথর নিক্ষেপ করবেন। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা শেষ হলে অনেকে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যাবেন। আর মক্কায় পৌঁছার পর হাজিদের একটি কাজ অবশিষ্ট থাকে। সেটি হচ্ছে, কাবা শরিফ তাওয়াফ করা। একে বলে বিদায়ি তাওয়াফ। স্থানীয়রা ছাড়া বিদায়ি তাওয়াফ অর্থাত্ কাবা শরিফে পুনরায় সাত বার চক্কর দেওয়ার মাধ্যমে হাজিরা সম্পন্ন করবেন পবিত্র হজব্রত পালন।
সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী ড. তৌফিক আল-রাবিয়া জানিয়েছেন, এবার বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২০ লাখের অধিক মুসল্লি পবিত্র হজ পালন করছেন।
২০২০ সালের করোনা মহামারি হানা দেয়ার পর— এবার প্রথমবারের মতো সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার একসঙ্গে হজ করছেন ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত সৌদি দূতাবাস জানিয়েছিল, ২০১২ সালে হজ করেছিলেন ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৫৭৩ জন হাজি। যা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হজ ছিল।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে হজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ১০ হাজার মানুষ; ২০২১ সালে ৫৯ হাজার। আর গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১০ লাখ।
এদিকে এবার হজের মৌসুমটা পড়েছে তীব্র গরমের মধ্যে। জানা গেছে, হাজিদের প্রায় ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এই গরমে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে যেন তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায় সেজন্য ৩২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
এমএইচএফ