২০১৮ সালে বাংলাদেশে এনার্জি ড্রিংকসে (শক্তিবর্ধক পানীয়) নেশাদ্রব্য ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, কোডিন, অপিয়েট ও যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রার উপাদান থাকায় পণ্যটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে বাজারে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংকস। প্রকাশ্যে এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩ সরকারি সংস্থার মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়। বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাই ‘নিরীহ দর্শক’ হিসেবে অবাধে অবৈধ এনার্জি ড্রিংকসের বিক্রি দেখছেন।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) দেশের বাজারে এনার্জি ড্রিংকসের উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তখন ল্যাবরেটরিতে ৭টি কোম্পানির এনার্জি ড্রিংকস পরীক্ষা করে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গিয়েছিল। নিষিদ্ধ এনার্জি ড্রিংকসগুলো হল- স্পিড, টাইগার, পাওয়ার, অস্কার, ব্রেভার, রেড বুল ও ব্ল্যাক হর্স। কিন্তু নিষিদ্ধ করার পরও সাতটি কোম্পানির এনার্জি ড্রিংকস বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ড্রিংকস যেমন- স্পার্ক, বিগ বস, বোস্ট, হর্স ফিলিংস, হর্স পাওয়ার, হর্স মাল্ট, জিনসিন, মাশরুম, হরমোম্যাক্স ও হান্টার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, কুলিং কর্ণার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুদির দোকানেও হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে এসব ড্রিংকস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে এনার্জি ড্রিংকস তৈরির অনুমোদন নেই। তবে কার্বোনেটেড বেভারেজ তৈরির অনুমোদন রয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে কার্বোনেটেড বেভারেজের (কোমল পানীয়) লাইসেন্স নিয়ে সুকৌশলে এনার্জি ড্রিংকস তৈরি করে। কার্বোনেটেড বেভারেজ হলো মাদকবিহীন তরল পানীয়বিশেষ। এতে কার্বনসমৃদ্ধ পানি, মিষ্টিজাতীয় পদার্থ, সহনীয় মাত্রায় ক্যাফেইন ও ফলের রস থাকবে। কিন্তু এনার্জি ড্রিংকসে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, ফেনসিডিল তৈরির উপাদান কোডিন, রাসায়নিক দ্রব্য অপিয়েট ও যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রার উপাদান সিলডেনাফিল সাইট্রেট মেশানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (বিসিএসআইআর) পরিচালক মাইনূল আহসান বলেন, এনার্জি ড্রিংকসে মেশানো রাসায়নিক দ্রব্য অপিয়েট একজন মানুষ একবার পান করলে তা আবারও পান করার জন্য অস্থির হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মিশ্রিত এসব এনার্জি ড্রিংকস পান করলে মানুষের কিডনি, লিভার, ব্রেইন ও হার্টের বড় ধরনের সমস্যাসহ জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শামীম বক্স বলেন, ‘এনার্জি ড্রিংকসে ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল রয়েছে, যা কিডনি, লিভার, মস্তিষ্ক ও হার্টের জন্য খুব ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ক্যাফেইন লিভারে চর্বি জমায়। রক্তনালির প্রশস্ততা কমিয়ে দেয়। ফলে রক্তপ্রবাহ কম হয়। এ ছাড়া এসব পানীয়তে প্রিজারভেটিস নামক এক ধরনের কেমিক্যাল আছে, যা লিভার ও কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এসব পানীয়তে স্যাকারিন ও এসপার্টেজের উপস্থিতির কারণে তা মানুষের ব্রেইনের নার্ভকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ও স্নায়ু দুর্বল করে ফেলে। এনার্জি ড্রিংকসগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সুগার থাকায় তা দাঁতের ও হাড়ের ক্যালসিয়াম ক্ষয় করে।’
বাংলাদেশে এনার্জি ড্রিংকস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অবাধে ও প্রকাশ্যে এসব পণ্য বিক্রি করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন। জানা গেছে, এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করার দায়িত্ব বিএসটিআই, বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। কিন্তু প্রশাসনের এই তিনটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এনার্জি ড্রিংকসের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
বিএসটিআই চট্টগ্রামের পরিচালক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এনার্জি ড্রিংকস তৈরির কোনো অনুমোদন নেই। কোম্পানিগুলো আমাদের থেকে কার্বোনেটেড বেভারেজ তৈরির অনুমোদন নেয়। কিন্তু তারা বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পণ্যের মিশ্রণে এনার্জি ড্রিংকস তৈরি করে। কার্বোনেটেড বেভারেজের মোড়কে তারা এসব এনার্জি ড্রিংকস বাজারজাত করে। কিন্তু এটা তদারকির দায়িত্ব কেবল আমাদের নয়। কারণ আমরা তো কাউকে এনার্জি ড্রিংকস তৈরির অনুমোদন দিই না।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্যভোগ ও ভোক্তা অধিকার) মো. রেজাউল করিম দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘এনার্জি ড্রিংকসের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে বিএসটিআই। যারা নিষিদ্ধ করেছে তাদেরই বিষয়টা তদারকি করার কথা। তাছাড়া এনার্জি ড্রিংকসে যেহেতু নেশাদ্রব্য ক্যাফেইন, অ্যালকোহল ও কোডিন রয়েছে, তাই এখানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরও ভূমিকা আছে।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের জনবলের সংকট রয়েছে। ঢাকায় আমাদের মাত্র দুজন ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। চট্টগ্রামে তো কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নেই। পুরো জেলা মিলে মাত্র একজন ফুড সেফটি অফিসার আছেন। এরপরও সীমিত জনবল নিয়ে আমরা মাঝে মধ্যে মোবাইলকোর্ট চালিয়ে বাজার থেকে নিষিদ্ধ এনার্জি ড্রিংকস জব্দ করি। এটা যেহেতু এখন আবার ছড়িয়ে পড়েছে, আমরা এটা নিয়ে পদক্ষেপ নেবো।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মজিবুর রহমান পাটওয়ারী দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘এনার্জি ড্রিংকসের উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করতে হলে আমাদের সঙ্গে বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয় থাকতে হবে। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় নেই। আর সমন্বয়টা করবে কে?’