স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের মৃত্যুর গহ্বর থেকে রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র পূর্ণতা লাভ করে। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ধর্মীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য চেতনা জাগ্রত করা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই চেতনায় বাঙালিদের সংগঠিত করেন। বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হন। ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে (পূর্ব) বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিরঙ্কুশ (প্রায় ৭৪ শতাংশের বেশি) সমর্থন ব্যক্ত করেন। কিন্তু নির্বাচিত বৈধ বাঙালি প্রতিনিধিদের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালিদের দমন ও নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।

বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল এ নেতা মহাবাঙালি ছিলেন, একজন আত্মপ্রত্যয়দীপ্ত বিশ্বাসী, স্বাধীন চেতনা সমৃদ্ধ একজন ব্যাঘ্র মানব। তার গলার স্বরের সঙ্গে অন্য কোনো বাঙালির স্বরের মিল ছিল না। কণ্ঠস্বর দিয়ে যদি কোনো ব্যক্তির পরিচিতি ঘটাতে হয়, তাহলে শেখ মুজিব ছিলেন এর অদ্বিতীয়। তার কণ্ঠ থেকে মাঝে মাঝে অগ্নিবীণা নিঃসৃত হতো। সাধারণ মানুষ তাই তার কণ্ঠকে বজ্রকণ্ঠ বলে অভিহিত করেছে। ব্যাঘ্রের গর্জন যেমন ছোটখাটো বন্য জন্তুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে, তেমনি শেখ মুজিবের কণ্ঠও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের একইভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলত। তার এক একটা শব্দ ও এক একটা বাক্যে পাকিস্তানি শাসকদের অন্তর কেঁপে উঠত।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ তার এই ঘোষণা রমনা রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে প্রকম্পিত করেছিল। প্রতিপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, শেখ মুজিব ও বাংলার জনগণ আর পাকিস্তানি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে রাজি নয়। পরিচয় পরিবর্তন করে তিনি বাংলাদেশের জনগণকে বাঙালি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।

তিনি ছিলেন ওইসব বিশ্বের মহান নেতাদের একজন, যারা জীবদ্দশায় তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে গেছেন। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, বাস্তবে স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন বাংলা তো তারই কৃতিত্ব। তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপের সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন তিনি। এর আগে বাঙালি এরূপ বিজয় আর কখনো উপভোগ করেনি। একটা বিজয়ী সেøাগান, একটা স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন জাতীয় সংগীত অর্থাৎ স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা এমনভাবে ইতোপূর্বে কেউ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। তাই বলা যায়, তিনি একজন সার্থক জাতির জনক।