বাংলাদেশে গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে প্রায় হারিয়েছেন ৯ হাজারের বেশি শ্রমিক। সর্বশেষ সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪৩২ শ্রমিকের প্রাণ ঝরেছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ বেশি। শ্রমিকদের এই মৃত্যুর মিছিলে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে পরিবহন সেক্টর। এছাড়া নির্মাণ, কৃষি, রেডিমেড গার্মেন্টস, ম্যানুফ্যাকচারিং, সিরামিক, ইটভাটা, চামড়াশিল্প ও জাহাজ ভাঙা শিল্পেও নিহতের সংখ্যা বাড়ছে।
গত শুক্রবার বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (ওশি) ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি যে কতটা অবহেলিত এবং প্রচলিত বিধিবিধানের প্রয়োগ কতটা ঢিলেঢালা, তা এই তথ্যের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে। প্রতি বছর ১৮ লাখ শ্রমিক যুক্ত হচ্ছে শ্রমশক্তিতে। সে অনুযায়ী চাকরির সংস্থান না হওয়ায় অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলেও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা বঞ্চিত। অনিরাপদ কর্মস্থলের কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রতি বছরই ঝরছে শত শত শ্রমিকের প্রাণ। এরপরও টনক নড়ে না কারো। ঝুঁকি নিয়েই কাজ করে যান শ্রমিকরা। এমনকি কোনো দুর্ঘটনার পরে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও পায় না নিহত শ্রমিকের স্বজনরা। দু-একটি ঘটনা বাদে নেয়া হয় না কোনো আইনগত ব্যবস্থাও। ফলে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের কাছে গুরুত্ব পায় না কখনোই।
বর্তমানে শ্রমজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব প্রকৃত শ্রমজীবী মানুষের হাতে নেই। ফলে কত অসহায় শ্রমিক শোষক সমাজের নিষ্ঠুর পীড়নে নিঃশেষিত হচ্ছে। আরো চিন্তার বিষয় হলো বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ শ্রমজীবী মানুষ, যাদের বেশিরভাগ আজো অধিকারবঞ্চিত। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে- এজন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধান থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয় না। এদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতা যেমন রয়েছে, তেমনি যথাযথ মজুরি নিশ্চিত না করা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টিও সাধারণ ঘটনা। অথচ আমাদের দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এসব খাতের শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থাও নেই।
আমাদের দেশে কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের মুনাফার দিকে যতটা মনোযোগ থাকে, নিরাপত্তার দিকে তারা ততটাই উদাসীন থাকেন। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। দেশে শিল্পায়নের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশের বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব দিতে না পারলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
কারখানা সংস্কার, বয়লার ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিল্প মালিক-শ্রমিক সবাই লাভবান হবেন। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিল্প মালিক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর আওতায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধানের যে নিয়ম রয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা, ২০১৩ সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে পরিস্থিতির নিশ্চিতভাবেই উন্নতি ঘটবে।