মহানুভব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ)

বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (দ) ছিলেন অনুপম চরিত্র-মাধুরী, উত্তম গুণাবলি ও সার্বিক সৌন্দর্যের অধিকারী। তার সব গুণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দেওয়া মানুষের সাধ্যাতীত। কেননা সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্বের সব কিছুই নবীজি (দ)-এর অর্জিত ছিল।

একবার হযরত আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল প্রিয়নবীর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘পবিত্র কোরআনই ছিল তার চরিত্র।’ অর্থাৎ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত সব প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলি দ্বারা তিনি ছিলেন গুণান্বিত।

হজরত মুহাম্মদ (দ) ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’। (সূরা আল-আহযাব : ২১)।

তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-বিনম্রতা, সত্যনিষ্ঠা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই বর্বর আরব জাতির আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তুমি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত’। (সূরা আল-কালাম : ৪)।

মুহাম্মদ (দ) জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে সদাচরণ করে পৃথিবীর বুকে অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নকারী ও প্রশিক্ষক হিসেবেই তাঁকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। মুহাম্মদ (দ) বলেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি’। (মিশকাত)।

হজরত জাবের (রা) হতে বর্ণিত, একবার তিনি এক যুদ্ধের অভিযানে নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। যখন রাসুল (দ) প্রত্যাবর্তন করলেন, তখনও তিনি তার সঙ্গে ছিলেন। দ্বিপ্রহরের দিকে বিশ্রামের সময় হলে তারা কাঁটাওয়ালা বৃক্ষপূর্ণ একটি উপত্যকায় পৌঁছলেন। রাসুল (দ) একটি বাবলা গাছের নিচে (বিশ্রামের জন্য) নেমে গাছের শাখায় তরবারি ঝুলিয়ে রাখলেন। এদিকে আমরাও শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর আমরা রাসুল (দ)-এর ডাক শুনতে পেলাম।

আমরা গিয়ে দেখলাম, তার নিকট এক বেদুঈন ব্যক্তি। রাসুল (দ) বললেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে সুযোগে এ লোকটি আমার ওপর আমার তরবারিটি উত্তোলন করেছিল। আমি হঠাৎ জাগ্রত হয়ে দেখলাম তার হাতে কোষমুক্ত তরবারি। সে আমাকে লক্ষ্য করে বলল, বল, এখন আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? আমি বললাম, ‘আল্লাহ’, ‘আল্লাহ’, ‘আল্লাহ’ তিনবার। এতে তার হাত থেকে তরবারি নিচে পড়ে গেল। তখন রাসুল (দ) তরবারি নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন, এখন কে তোমাকে আমার হাত হতে রক্ষা করবে? তখন বেদুঈন বলল, আমি আশা করি, আপনি উত্তম তরবারি ধারণকারী হবেন।

অর্থাৎ আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। তখন রাসুল (দ) বললেন, তুমি কি এ সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল? তখন বেদুঈন বলল, আমি এটা বলব না; কিন্তু আপনার সঙ্গে এ ওয়াদা করছি যে, আমি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না এবং ওই সব লোকের সঙ্গেও থাকব না যারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অতঃপর রাসুল (দ) তাকে ছেড়ে দিলেন। সে তখন তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে এসে বলল, আমি মানব জাতির একজন শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির কাছ থেকে তোমাদের নিকট এসেছি। (বুখারি : ২৯১০; মুসনাদে আহমদ : ১৫১৯০)।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে লক্ষ করে ইরশাদ করেন, হে বাছা! যদি তোমার পক্ষে সকাল-সন্ধ্যা এভাবে কাটানো সম্ভব হয় যে, তোমার অন্তরে কারো প্রতি মলিনতা নেই, তবে সেভাবে কাটাবে। তারপর বললেন, হে বাছা! এটা আমার সুন্নত। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে জিন্দা করল, সে আমাকেই ভালোবাসল। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে থাকবে। (জামে তিরমিযী : ২৬৭৮)।

এ হাদিস দ্বারা নবী কারীম (দ)-এর সুন্নত ও জীবনাদর্শের একটি দিক সম্পর্কে আলো পাওয়া যায়। তিনি সে আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য সরাসরি প্রিয় খাদেম হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা)-কে উপদেশ দিয়েছেন। আর তার মাধ্যমে এ উপদেশ তাঁর উম্মতের সকলের প্রতি। যেন তাঁর উম্মতের প্রত্যেকে এ আলোয় আলোকিত হয়।

তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা)-কে উপদেশ দিয়েছেন, যেকোনো মানুষের ব্যাপারে তার অন্তর নির্মল রাখতে। সকাল-সন্ধ্যা এভাবে কাটাবেন যে, তার অন্তরে কারো প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই, কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই এবং কোনো রাগ ও ক্ষোভ নেই। যে যত দুঃখ-কষ্ট দিক, মনে যত বড় আঘাতই দিক, অবিলম্বে সে আঘাতের চিহ্ন মুছে ফেলবে। মুখে ক্ষমা ঘোষণা করবে এবং অন্তর পরিষ্কার করে ফেলার চেষ্টা করবে। যেন কোনো দিন তার পক্ষ থেকে সে কোনো কষ্ট পায়ইনি।