পিলখানা হত্যাকান্ড: নেপথ্যের কারণ খুঁজতে উচ্চ আদালতের পরামর্শ উপেক্ষিত

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকান্ডের ১৪ বছরেও বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়ায় স্বজনরা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।  দ্রুত বিচার সম্পন্নের পাশাপাশি সেই বিদ্রোহের পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটন চেয়েছেন নিহতের স্বজনরা।  ২০১৭ সালে পিলখানা হত্যাকান্ডের নেপথ্যে কী, তার কারণ খুঁজতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।

এতে আদালত বলেছেন, সরকার প্রয়োজন মনে করলে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।  কিন্তু আদালতের সেই পরামর্শ উপেক্ষিত হয়ে আছে আজো।
শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার বনানীর সামরিক কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা স্বজনহারা কয়েকজন আদালতের সেই পরামর্শ এবং দ্রুত বিচার সম্পন্নে নিজেদের চাওয়ার কথা জানালেন গণমাধ্যমকে।

বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমানের ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, কোনো একটা জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করা হোক আন্ডার রিটায়ার্ড সুপ্রিম কোর্ট জাস্টিস।  সে জুডিশিয়াল ইনুকোয়ারি কমিশনটা এটা তদন্ত করে দেখবে যে, পর্দার আড়ালে কী ছিল? সেটা যদি না হয়, তাহলে কিন্তু ইভেনচুয়ালি যদি ফাঁসিও হয়ে যায়, তাহলেই বা কী? এটা তো স্বাভাবিক, যে কোনো অপরাধীর তো ফাঁসি হবে।  এটাতে খুশি হওয়ার কিছু নাই।  পর্দার আড়ালে যারা রয়ে গেল, তাদেরকে কিন্তু আমরা খুঁজে পেলাম না।

কুদরতের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, তাকে (ছেলে) হত্যার কারণ কী, জানি না।  তবে তার মেধাই বোধহয় কাল হয়েছিল।  আজও বিচার পাইনি।  এটা আমাদের বেদনার ব্যাপার, কষ্টের ব্যাপার।  আমি ৮৭ বছর বয়সে এই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেঁচে আছি।  কিন্তু কুদরতের মা তিন বছরের বেশি আর বাঁচতে পারেনি।  বিচার (শেষ) কবে হবে জানি না।  জানি না জীবদ্দশায় দেখতে পাব কি না।

মেজর মোহাম্মদ মাকসুম-উল-হাকিমের বয়োজ্যেষ্ঠ শ্বশুর বলেন, সরকার ডাকে আমরা আসি।  শোকসভা করে চলে যাই।  ডেথ রেফারেন্স যে আটকে আছে, এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হলে আমরা রায়টা দেখতে পারবো।  সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছি।

নিহত মেজর জেনারেল শাকিলের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বিচার সম্পূর্ণ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি বিচার পাব না।  বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচার হবে না, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচার সম্ভব না।  কেন এরকম আশঙ্কা করছেন প্রশ্নের জবাবে রাকিন বলেন, কিছু মানুষের লজ্জা নাই।  মানুষের তো লজ্জা থাকে।
একসঙ্গে মা ও বাবাকে হারানো রাকিন আরো বলেন, আপনারা সত্য প্রচার করতে পারবেন না, বলে লাভ নাই।  অযথা সময় করছেন।  আমি যা বলব, তা প্রচার করতে পারবেন না।
শাকিল আহমেদের ছোট বোন রুবিনা নেসা বিষন্ন কণ্ঠে বলেন, দীর্ঘ দিন হয়ে গেল।  মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে আছে।  আশা করছি, কিছু একটা বিচার পাব। আমরা পরিবারের সবাই সেই অপেক্ষায় আছি।

নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরা বনানী সামরিক কবরস্থানে স্বজনের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, অশ্রুনয়নে প্রার্থনা করেন।  এসময় আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়েন কেউ কেউ।

এদিকে আলোচিত এই হত্যামামলার আপিল শুনানি চলতি বছরেই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।  তিনি বলেন, এ মামলায় বিশেষ কোনো বেঞ্চ গঠনের প্রয়োজন নেই।  আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চেই এর শুনানি শুরু হবে।  চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই শুনানি হবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আলোচিত এ মামলার আপিলের সারসংক্ষেপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষকে।  সেটি চার সপ্তাহ থেকে ছয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে হতে পারে, এর বেশি কোনোভাবেই হবে না।  ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম এ মামলার সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার সদর দপ্তরে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বাহিনীর তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়।  সব মিলিয়ে প্রাণ হারান ৭৪ জন।  এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় দুটি মামলা হয়।  হত্যামামলায় বিচারিক আদালত ২০১৩ সালে ১৫২ জনকে ফাঁসি, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন।  দেশের ইতিহাসে নৃশংসতম এই হত্যাযজ্ঞে বিস্ফোরক আইনে করা অন্য মামলার বিচার এখনো বিচারিক আদালতেই শেষ হয়নি।  আসামির সংখ্যার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে বৃহত্তর পিলখানা হত্যা মামলা।

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকান্ডের এক মামলার বিচারের দুই ধাপ শেষ হয়েছে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে।  রায় কার্যকর করতে হলে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হবে।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, শেষ ধাপটি চলতি বছরই হতে পারে।  হত্যা মামলায় হাইকোর্টে খালাসপ্রাপ্ত এবং যাদের সাজা কমানো হয়েছে, তাদের সাজা বাড়াতে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।  মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস চেয়ে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিলও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথমে উভয়পক্ষের লিভ টু আপিলের গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানি হবে।  তারপর আপিলের শুনানি ও মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে।

তবে কিছুদিনের মধ্যেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।  তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৩৩টি আপিল দাখিল করা হয়েছে।  সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছর আপিল শুনানি হতে পারে।

পিলখানা হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল করা হয়েছে।  আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ২০৩ আসামির পক্ষে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল করেছেন।  এরমধ্যে ৮২ জনের পক্ষে আপিল এবং বাকিদের পক্ষে লিভ টু আপিল করা হয়েছে। আসামিদের পক্ষে একাধিক আইনজীবী বিলম্ব মওকুফের আবেদনসহ আপিল দাখিল করেছেন বলে জানা গেছে।

আদালতের নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দাখিল করতে হয়।  ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায়ের পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১১ দফা পর্যবেক্ষণসহ ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় (ডেথ রেফারেন্স ও আপিল) প্রকাশিত হয়।  কিন্তু করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এ কারণে উভয়পক্ষের আপিল দাখিল করতে দেরি হয়।  তাই প্রধান বিচারপতির অনুমতি নিয়ে বিলম্ব মওকুফের আবেদনসহ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় অন রেকর্ডের মাধ্যমে আপিল দাখিল করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম আপিলটি করা হয়।  এটি ছিল ৬৬ হাজার পৃষ্ঠার।  বই বাইন্ডিং, রায়ের সার্টিফায়েড কপি, প্রতিটি চারশ পাতার ভলিয়ম তৈরি, প্রতিটি আপিল ১৪টি সেট প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ দাখিল করা হয়েছে।  এরপর পেপারবুক ছাড়াই মেমো নম্বর দিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও ৪৭ টি আপিল দাখিল করা হয়েছে।

ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে প্রতি মাসে দুইদিন করে বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।  সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।  এ মামলার বিচারকাজ এবছর শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।  বিস্ফোরক আইনে করা অন্য মামলার কার্যক্রম ১৩ বছর ধরে চলছে।  এখন পর্যন্ত এক হাজার ৩৪৫ সাক্ষীর মধ্যে ১৮৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, আসামিরা ১২ বছর ধরে কারাগারে আছে।  ২৫৬ আসামির ১০ বছর করে সাজার মেয়াদ ছিল।  তাদের সাজা ভোগ শেষ হয়েছে।  কিন্তু বিস্ফোরক মামলা বিচারাধীন থাকায় তারা মুক্তি পাচ্ছে না।  ন্যায়বিচারের স্বার্থে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়।  ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড, প্রয়াত নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।  অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়।

মামলার মোট আসামি ৮৩৪ জন।  এরমধ্যে ২৪ জন মারা গেছে এবং পলাতক ২০ জন।  দুটি মামলার একই আসামি হওয়ায় তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রতি মাসে দুই থেকে তিন দিন মামলার কার্যক্রম চালানো হয়।  ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদন্ডের (ফাঁসি) রায় বহাল রাখেন।  ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন হাইকোর্ট।  খালাস পান ৪৯ জন আসামি।