গাছ কেটে র‌্যাম্প করলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি

শতবর্ষী কোনো গাছ কাটা পড়বে না : সিডিএ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে র‌্যাম্প নির্মাণের জন্য নগরীর টাইগারপাস থেকে রেলওয়ে পাবলিক হাই স্কুল গেট পর্যন্ত দ্বিতল আইকনিক সড়কটির ছোট-বড় ৪৬টি গাছ কাটতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এদিকে, গাছগুলো না কেটে দৃষ্টিনন্দন সড়কটির সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখে র‌্যাম্প নির্মাণের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেছে নাগরিক সমাজ-চট্টগ্রামের ব্যানারে পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা। গাছ নিধন বন্ধের পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন সড়কটি বাঁচাতে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন তারা। এদিকে শতশর্ষী কোনো গাছ কাটা পড়বে না, বরং ২০-২৫টি ছোট গাছ কাটার বদলে ৫০০ ছারা গাছ রোপন করে আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে সিডিএ। অন্যদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষের সাথে গাছ কেটে র‌্যাম্প নির্মাণ না করতে সাক্ষাৎ করবেন নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দরা।

সোমবার বিকালে নগরীর টাইগারপাস মোড়ে শতবর্ষী গাছের নিচে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন পরিবেশ প্রেমীরাও। তাদের দাবি, টাইগারপাস-সিআরবির শতবর্ষী গাছ ও সড়ক ধবংস করে র‌্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা অবিলম্বে না আসলে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, সড়কটির টাইগারপাস থেকে রেলওয়ে পাবলিক হাই স্কুল গেট পর্যন্ত ছোট-বড় প্রায় ১৫০টি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে পুরোনো রেইনট্রি গাছ রয়েছে অন্তত তিনটি। ইতোমধ্যে গাছগুলো কাটার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতিবাদে যোগ দেওয়া পরিবেশবিদ অধ্যাপক মো. ইদ্রিস আলী দেশ বর্তমানকে বলেন, যারা সিআরবি ধ্বংস করতে পারেনি তারা এখন সিআরবির প্রতিবেশ ধ্বংস করতে চায়। তারা বলছে মাত্র ৪৬টি গাছ কাটা হবে। এটা কেমন মুর্খতা। তারা শতবর্ষী গাছ কেটে চারা লাগাতে চায়। ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই। যারা ৬ কিলোমিটার রাস্তা করতে ১৮টি গাছ কাটার পরিকল্পনা করছে তারা মানুষ নামের শকুন। গাছ কাটা ও পরিবেশ ধ্বংস থেকে ফিরে না আসলে তরুণদের নিয়ে আমরা আন্দোলন করে সিডিএকে সরে আসতে বাধ্য করব।

প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান দেশ বর্তমানকে বলেন, আমরা কেউ উন্নয়ন বিরোধী নই। এই র‌্যাম্প এখানে কেন? এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার সময়ও শুরুর স্থান নিয়ে সমস্যা হয়। এটা দেওয়ানহাট থেকে শুরু করা যেত। এখনই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। না হলে আন্দোলন সংগ্রাম করে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করব।

আরেক অংশ গ্রহণকারী খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, এই সড়ক শুধু চট্টগ্রামের নয়। দেশের ও বিশ্ব প্রকৃতির সম্পদ। যা সৃষ্টি করতে পারবেন না তা কেন ধ্বংস করছেন। এই নান্দিকতা দেশের সম্পদ। অবিলম্বে সিডিএ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘোষণা দিন। নিউমার্কেট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের অনেক বিকল্প আছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার সঙ্গে রেলওয়ের সিআরবি ও পলোগ্রাউন্ড মাঠের সংযোগ স্থাপনে পাহাড়ের ঢালে টাইগারপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়। সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশের ওপরের অংশে টাইগারপাস থেকে যাতায়াত এবং নিচের অংশে নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী সড়ক নির্মাণ করা হয়। এটি স্থানীয়দের কাছে দ্বিতল সড়ক হিসেবে পরিচিত। পাহাড় অক্ষুণ্ন রেখে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এ সড়কের নামকরণ করা হয় ইউসুফ চৌধুরীর নামে। এ সড়কের বিভাজক হিসেবে রাখা হয়েছে পাহাড়ের ঢাল। সড়ক বিভাজকে রিটার্নিং ওয়াল ছাড়াও লাগানো হয়েছে কয়েকশ ছোট-বড় গাছ। বেশকিছু গাছের বয়স ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। এসব গাছে নানা রকম পাখির বাসাও রয়েছে।

৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে করা এ এক্সপ্রেসওয়ে গত বছরের নভেম্বরে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় এটি এখনো যানবাহন চলাচলের জন্য চালু করা হয়নি। সময়মত কাজ শেষ করতে না পারায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, এক্সপ্রেসওয়ের ১৪টি র‌্যাম্পের মধ্যে একটি জিইসি মোড়ে, দুটি টাইগারপাসে, চারটি আগ্রাবাদে, একটি ফকিরহাটে, দুটি নিমতলায়, দুটি সিইপিজেডে এবং দুটি কেইপিজেডে নির্মাণ করা হবে। টাইগারপাস মোড়ে দুটি র‌্যাম্পের মধ্যে একটি হবে সিআরবি হয়ে নিউ মার্কেটমুখী সড়কে, অন্যটি হবে আমবাগানমুখী সড়কে। দেওয়ানহাট ব্রিজের শেষ প্রান্ত সংলগ্ন অংশ থেকে টাইগারপাস মোড় ঘুরে সড়কের মাঝ বরাবর গিয়ে পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের অংশ পর্যন্ত প্রস্তাবিত র‌্যাম্পটি হবে। এটি নির্মাণে ১৪ শতক জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে চিঠি দিয়েছে সিডিএ।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সন্ধ্যায় দেশ বর্তমানকে তিনি বলেন, র‌্যাম্প নির্মাণে গাছ কাটা নিয়ে বর্তমানে যারা প্রতিবাদ করছেন, তারা এটি ভুল বুঝছেন। পরিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সিআরবি এলাকায় র‌্যাম্প নির্মাণ করা হবে। কোনো শতবর্ষী গাছ কাটা পড়বে না। ছোটগাছ যেগুলো কাট পড়বে, এর কয়েকগুন বেশি গাছ আমরা লাগিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবো। ফলে পাহাড়ি এ সড়কে র‌্যাম্প নির্মাণে গাছ কাটা হলেও পরিবেশের ক্ষতি হবে না। বরং আগের চেয়ে ভবিষ্যতে সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, র‌্যাম্প নির্মাণের জন্য ৪৪টি গাছ কাটা হবে। ইতোমধ্যে গাছ কাটার অনুমতি নেওয়া হয়েছে। রাস্তার অবয়ব ঠিক থাকবে। পিলারের মাধ্যমে র‌্যাম্প নামানো হবে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন বলেন, সিডিএ আমাদের কাছে জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে। এ সংক্রান্ত পূর্ব রেলের ডিআরএম এর নেতৃত্বে আমাদের সাত সদস্যের একটি বিভাগীয় কমিটি আছে। অনুমোদনের আগে বিভাগীয় কমিটি জমিটি পরিদর্শন করবে। সেখানে কি পরিমাণ জমি আছে, কত গাছ আছে, গাছ কাটা হবে কিনা- সব বিষয় যাচাই করে বিভাগীয় কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এরপর অনুমোদনের জন্য সদর দপ্তরে যাবে।

উল্লেখ্য, আজ (মঙ্গলবার) দুপুরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষের সাথে গাছ কেটে র‌্যাম্প নির্মাণ না করতে সাক্ষাৎ করবেন নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের ড. অনুপম সেন, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম চৌধুরী বাবুল, ড. একিউএম সিরাজুল ইসলাম. সাংবাদিক নেতা মহসিন কাজী, চৌধুরী ফরিদসহ নেতৃবৃন্দরা।