বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি ও পরিবেশ দেখতে একটি প্রতিনিধি দল গতকাল শুক্রবার মিয়ানমারে গেছেন। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ২৭ সদস্যের এই দলে রয়েছেন সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিবসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি। সার্বিক দিক সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে এই প্রতিনিধি দলের গতকালই আবার দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে।
এর আগে গত ১৫ মার্চ প্রায় একই মিশন নিয়ে মিয়ানমার সরকারের একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজার সফর করে গেছেন। নানান কারণে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দুইদেশের মধ্যে এই অমীমাংসিত বিষয়টি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা। আদৌ রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে পারবে কিনা। কারণ মিয়ানমারের সামরিক সরকার তার দেশের নাগরিক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিবে কিনা, তাদের সদিচ্ছা নিয়ে একাধিকবার এই প্রশ্নটি উঠে এসছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে জান্তা সরকারের একগুঁয়েমি মনোভাব এবং আন্তরিকতার বিষয়টি তাদের আচার-আচরণে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মন্ডু ও আশে-পাশের এলাকার বার্মিজ মুসলমানদের বসবাস দীর্ঘ বছরে। জন্মসূত্রে আদি বাসিন্দা হওয়া সত্বেও গত অর্ধ শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ণের শিকার হয়ে আসছে এই বিশাল জনগোষ্ঠী। তুচ্ছ কারণে সামরিক বাহিনী কর্তৃক তাদের বাড়ি-ঘর জ¦ালিয়ে দেয়া, মারধর,অত্যাচার,নির্বিচারে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
নিজ দেশে এভাবে বারংবার অত্যাচার-নিপীড়ণের শিকার হয়ে এক পর্যায়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় এসব রোহিঙ্গারা।
সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গড়ে উঠে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ। বিশেষ করে ৭০ দশকে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামী ফোর্স (আরিফ) এর মতো কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠে। মিয়ানমার সামরিক সরকারে দমন নীতির বিরুদ্ধে এই সংগঠনগুলোর তৎপরতা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
তবে এতে করে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, এইসব সশস্ত্র বিদ্রোহী রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের সাথে সামরিক বাহিনীর মাঝে-মধ্যে গুলী বিনিময়, সংঘর্ষ, চোরাগুপ্তা হামলা ইত্যাদি। এর জন্য বড় ধরণের খেসারতও দিতে হয়েছে। বিদেশি মদদপুষ্ট সামরিক বাহিনী আন্তর্জাতিক মহলের অনুরোধ, নিষেধোজ্ঞা ইত্যাদিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে। তাদের সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ১৯৭৮ সালে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।
সেই সময়কার লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়টি সুরাহা হয়নি। দফায় দফায় দুইদেশের প্রতিনিধি দলের আসা-যাওয়া, জাতিসংঘের নিন্দা, উদ্বেগ প্রকাশ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ প্রয়োগ, মানবাধিকার সংস্থার অনুরোধ ইত্যাদির মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। এর মাঝে মরার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতোই আরেক দফা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সশস্ত্র সংগঠন আরসার সাথে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর রেশ ধরে ফের আরাকানে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের আক্রমণ শুরু হয়। আবারো পুরানো পন্থায় হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে।
নতুন করে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশয় নেয় বাংলাদেশে। আবার আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি, চাপ প্রয়োগ এসব শুরু হয়। এবারেও পুরো বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। প্রবেশ করেছে সাড়ে ১১ লাখ, অপরদিকে কয়েক দফায় বৈঠক ইত্যাদি শেষে ৬ বছরে ফেরত নিয়েছে মাত্র ৫ শতেরও কম। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সঙ্গত কারণেই মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি এখন বিভিন্ন মহলে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। তারা আদৌ তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিবে কিনা!