শিশুশ্রম শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী একটি আদি ও জটিল সমস্যা। বিশ্বের নামীদামী অনেক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করে আসছে, তবুও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। একশ্রেণির মুনাফাখোর শিশুদের অল্প মজুরি দিয়ে অধিক মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করছেন। আর শিশুরা অভাবে পড়ে জড়িত হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় এমনই মত মানবাধিকার কর্মীদের। যেখানে শিশুদের জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।
বাসের হেল্পার, ইট ভাটায়, কলকারখানা ও নির্মাণ শ্রমিকের মতো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যাপকভাবে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বস্তি এলাকায় মাদক চোরাচালানের সাথেও অসাধু লোকজন শিশুদের জড়িয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জাতীয় সংসদে বলেছেন, দেশে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর মোট সংখ্যা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন, মানে ১৭ লাখ। এরমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন, মানে ১২ লাখ। এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। শিশুরা নিউমোনিয়া, কাশি, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দুরোরোগ্য ব্যাধিসহ নানা রোগ আক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
কেস হিস্ট্রি :
মো. রিদোয়ান বয়স ১৩-১৪ বছর। সে লেগুনা গাড়ির হেল্পারের কাজ করে। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, সে চট্টগ্রাম নগরীর কালারপোল এলাকায় একটি বস্তিতে থাকে। পিতা দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। অসুস্থ হওয়ার আগে গাড়ির চালক ছিলেন। তার মা এখন বাসা বাড়িতে কাজ করেন। রেদোয়ান তার পরিবারের বড় সন্তান। তাই অভাবের সংসারে শিশু বয়স থেকে কাঁধে তুলে নিয়েছে পরিবারের বোঝা। সে লেখাপড়া না করলেও তার ছোট বোন ফাতেমা পড়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে।
জীবিকার তাগিদে দুই বছর ধরে করছে হেল্পারের কাজ। সারাদিন কাজ শেষে তিনশ টাকা বেতন পায় রেদোয়ান। যা দিয়ে তার পরিবারে খরচ বহন করে সে। শিশু রেদোয়ান হয়তো নিজেও জানে না, কোন অজানা পাপে শিশু বয়সেই তাকে জীবন যুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। বয়সটা এমন, যে বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার কথা।
নগরীর মুরাদপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরিগুলোতে অবাধে চলছে শিশুশ্রম। যা বর্তমান সময়ে অতি স্বাভাবিক একটি বিষয়। অভাবের সুযোগ নিয়ে অল্প বেতনে শ্রম শোষণ করছেন কারখানা মালিকেরা।
ফারুক নামে এক কিশোর জানায়, সে প্রায় চার পাঁচ বছর ধরে অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে। প্রথম দিকে একটু কষ্ট হলেও এখন সয়ে গেছে। সে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বর্তমানে তার বয়স ১৪-১৫ বছর।
এভাবে শহরের আনাচে কানাচে খুব স্বাভাবিকভাবেই চলছে শিশু শ্রম। কখন অভাবে, আবার কখনও নিয়তির কারণে শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। হারাচ্ছে শিক্ষার অধিকার, সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা ও সুন্দর ভবিষ্যৎ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. তৌফিকুল আরিফ জানান, শিশু শ্রমের উপর বর্তমানে সঠিক কোন পরিসংখ্যান তাদের হাতে নেই। আগামী মাসে প্রকাশিত হতে পারে বিবিএস রিপোর্ট। প্রতি দশ বছর অন্তর এই জরিপ হয়ে থাকে। তবে সবশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুসারে, দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ লাখ শিশু শ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্য নিয়ে সরকার অভিভাবক ও কারখানার মালিকদের শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতন করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ বিষয়ে ৩৮টি খাতের মধ্যে ইতিমধ্যে আটটিকে শিশু শ্রম মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী জিয়া হাবিব বলেন, শিশুশ্রম সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। শিশুদের যখন স্কুলে যাওয়ার কথা এবং মাঠে খেলাধুলা করার কথা তখন অভাবের কারণে তাদের কাজে যেতে হচ্ছে। শিশুদের শৈশব কৈশোর নিষ্ঠুর ভাবে কেড়ে নিচ্ছে এই শিশু শ্রম। অনেক শিশুকেই অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেমন বাসের হেল্পার, কেমিকেল কারখানার শ্রমিক, লেদ মেশিনে কাজ করা, উপকূলের চরাঞ্চলে শুটকি তৈরির কাজ করতে হচেছ। যার ফলে অনেক শিশুই শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, মাদক চোরাচালান, বিক্রিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার হচ্ছে শিশুরা। মূলত এক শ্রেণির মানুষ দারিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটনকে কাজে লাগিয়ে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করছেন বলে জানান তিনি।
জিয়া হাবিব আরও বলেন, এটা সমগ্র জাতি, সমাজ এবং পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক ও দুর্ভাগ্যজনক। তিনি সরকার, জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংগঠন, সমাজসেবী, মানবাধিকার কর্মী এবং সর্বোপরি দেশবাসীকে শিশুদেরকে শিশুশ্রমের হাত থেকে মুক্তি দিতে এক যোগে কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ কারও একার পক্ষে এ সংকট মোকাবেলা সম্ভব নয়, তাই সকলকে সচেতনভাবে শিশুদের একটি সুন্দর ভবিষৎ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মনে করেন।