ভূমি দুস্যদের পেটে ঢুকে যাচ্ছে কর্ণফুলী

সংকুচিত হয়ে আসছে কর্ণফুলী। সরকারি সংস্থা ও প্রভাবশালীদের বেনিয়া মনবৃত্তির কারণে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন কর্ণফুলী এখন সরু খালের পথে।  নদীর জমিতে অবকাঠামো করার অনুমতি কোনো সরকারি সংস্থা দিতে না পারলেও খোদ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মানেনি।  নদীর উত্তর ও দক্ষিণ তীরে জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ লীজ দিয়ে কর্ণফুলী নদী নিয়ে বাণিজ্য করছে।  কর্ণফুলী ড্রাই ডকসহ সব ধরণের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিলেও তা তিন মাসেও কার্যকর হয়নি।  জেলা পর্যায়ে প্রতি মাসে নদী রক্ষা কমিটির সভাও নিয়মিত হয় না।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর দুই পাড়ে দখলের কারণে কর্ণফুলীর প্রশস্ততা ক্রমেই কমছে।  বর্জ্যরে কারণে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। জেলা প্রশাসন এবং বন্দর কর্ণফুলীর দেহ লীজ দিয়ে ব্যবসা করছে।  ব্যবসায়ীরা নদী ড্রেজিং এর নামে বালি নিয়ে ব্যবসা করছে। তারা বলছেন, জেলা প্রশাসন, বন্দর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, ওয়াসার সমন্বয়হীনতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক কর্ণফুলী প্রাণ হারাচ্ছে।  কিন্তু কর্ণফুলীর কান্না শুনছে না কেউ।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, চট্টগ্রামে পরিদর্শনের সময় কর্ণফুলীর দুই তীরে সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দিয়েছি।  প্রশাসন ঢিমেতালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও নদী রক্ষা কমিশনের কাজে কোনো হেলাফেলা নেই।

তিনি বলেন, কর্ণফুলী সাধারণ কোনো নদী নয়।  দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ নদী।  কর্ণফুলী নদী দখল হয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
জেলা প্রশাসন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলীর দুই তীরে দুই হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।  এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ ছয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবৈধ দখলে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।  জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নিজস্ব ওয়েবসাইটে বন্দর ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থাকে ‘অবৈধ দখলদার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।  ২০১৫ সালের ৯ জুন চট্টগ্রাম মহানগরের আাগ্রাবাদ, বাকলিয়া, পতেঙ্গা ভূমি অফিস ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যৌথ স্বাক্ষরে নদীর দুই তীরে প্রায় আড়াই হাজার অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করা হয়।

সহকারী কমিশনার (ভূমি, আগ্রাবাদ সার্কেল) মো. আবু হাসান সিদ্দিক ওই সময় ‘কর্ণফুলী নদীর সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি’র আহ্বায়ক ছিলেন।  ওই তালিকায় বেশির ভাগ অবৈধ স্থাপনার পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে কর্ণফুলী নদীর উত্তর তীরে বাকলিয়া, চাক্তাই, ফিরিঙ্গীবাজার, মাঝিরঘাট, মনোহরখালী, স্ট্র্যান্ড রোড ও পতেঙ্গা এলাকায়।  অন্যদিকে নদীর দক্ষিণ তীরে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কালুরঘাট ব্রীজ পর্যন্ত অবৈধ দখলদারদের নাম ও জায়গার পরিমাণও প্রকাশ করা হয়েছে। এসব এলাকায় বস্তি, বিভিন্ন পণ্যের গুদাম, কারখানা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে ওঠেছে।

সরেজমিনে পরিদর্শন ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে এসেও ২০১৫ সালে প্রকাশিত অবৈধ দখলদারদের নামের বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।  কর্ণফুলী নদী সংলগ্ন জেগে ওঠা বিশাল চর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বস্তি এলাকা।  প্রায় ৫০ একর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বাকলিয়া বহুমুখী বাস্তুহারা কলোনী।  কর্ণফুলী সেতু সংলগ্ন কলেজ রোড এলাকায় ৩০ একর জায়গা অবৈধ দখলে আছে প্রায় বিশ বছর ধরে।  কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনায় জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে একটি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলীর তীর দখল করে বাণিজ্য করলেও সেদিকে নজর নেই প্রশাসনের। জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালে হাইকোর্টে রীট করলেও সেটি খারিজ করে দেন আদালত।  কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে প্রায় ২০ একর জায়গা দখল করে আছে কর্ণফুলী ড্রাই ডক।  খোদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ড্রাই ডক।  গত বছরের নভেম্বর মাসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সরেজমিনে চট্টগ্রাম পরিদর্শনে এসে এটি উচ্ছেদের জন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেও তা আজও কার্যকর হয়নি।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে চাক্তাই খালের মোহনায় কর্ণফুলীর প্রশস্ততা ছিলো ৯৫২ দশমিক ২৯ মিটার।  একই জায়গায় ২০০০ সালে প্রশস্ততা ছিলো ৯৩০ দশমিক ৩১ মিটার এবং ২০১৩ সালে ১৫ এপ্রিল পরিচালিত অন্য এক জরীপে নদীর প্রশস্ততা ৬৬৬ দশমিক ৫৬ মিটারে ঠেকেছে।  অবশ্য ১৯৮৫ সালে নদীতে চর দেখা যায়নি।কর্ণফুলী নদীর দুটির পিলার এবং মানব সৃষ্ট বর্জ্যরে কারণে কর্ণফুলীর প্রশস্ততা হ্রাস পায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া মাঝিরঘাট, স্ট্র্যান্ড রোড, মনোহর খাল, পুরনো ব্রীজ ঘাট এলাকায় নদীর প্রশস্ততা কমেছে বলছেন কর্ণফুলী নদীর দখল ও দুষণ নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত অধ্যাপক প্রফেসর ইদ্রিস আলী।  তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর, জেলা প্রশাসন, সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার সমন্বয়হীনতার কারণে কর্ণফুলীর দুই তীর প্রভাবশালীরা গিলে খাচ্ছে।  সবাই কর্ণফুলীর দেহ নিয়ে বাণিজ্য করছে। সরকারি সংস্থাগুলো একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়ায়। কর্ণফুলীর কান্না কেউ শুনছেনা।

নদী রক্ষার জন্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি রয়েছে।  বিভাগীয় পর্যায়ে স্থানীয় বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা পর্যায়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসক কমিটির চেয়ারম্যান এবং সদস্যসচিব অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)।  জেলা পর্যায়ে ২৩ সদস্যের কমিটি থাকলেও কমিটির বৈঠক অনিয়মিত।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রাম ঘুরে যান।  এ সময় তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনকে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে গড়ে ওঠা কর্ণফুলী ড্রাই ডকসহ সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দিলেও তা আজও কার্যকর হয়নি।

জানা যায়, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে এ পর্যন্ত তিনবার তাগাদা পত্র দেওয়া হয়েছে কিন্তু জেলা প্রশাসনের পক্ষে কোনো সাড়া মেলেনি।  এ ব্যাপারে খোদ কমিশনের চেয়ারম্যান ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ খায়রুজ্জামান বলেন, কত দিনের মধ্যে সভা আহবান করতে হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কমিটি প্রয়োজনবোধ করলে বৈঠকে বসবে।  অবৈধ স্থাপনা প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন, কর্ণফুলীর তীরে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদে প্রশাসনের কোনো শৈথিল্য নেই। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ একটি চলমান প্রক্রিয়া।  কিছু দিন ধরে পাহাড় দখলদারদের উচ্ছেদ নিয়ে কাজ করছি।  কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো ধরনের শৈথিল্য নেই প্রশাসনের।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো জায়গা অবৈধ দখলে নেই।

কর্ণফুলী নদীর দখল নিয়ে গতকাল বুধবার টেলিফোনে কথা হয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমানের সাথে।  তিনি নদী রক্ষা কমিটির বৈঠক প্রসঙ্গে বলেন, মাসে একবার কমিটির বৈঠকের জন্য বলা হয়েছে।  নানা কারণে সেটা হয়ে ওঠেনা। উচ্ছেদ একটি চলমান প্রক্রিয়া।   যে ছোট একটা ঘর তুলে নদীর পাড়ে থাকছে সে-ও অবৈধ দখলদার আর যে বড় স্থাপনা গড়ে তুলেছে, সে বড় দখলদার।  সবাইকে উচ্ছেদ করতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, একদিকে নির্বিচারে দখল, অন্যদিকে অবাধে দূষণ, সব মিলিয়ে বিপন্ন কর্ণফুলী নদী।  তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের ডিসিকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সব বাতিল করে নদীর জমি খাস খতিয়ানে নিয়ে আসতে।  সেই আদেশ প্রতিপালিত হয়েছে কিনা, তা জানাতে পত্র দিয়েছি কিন্তু সাড়া পাইনি।