নান্দকিতার ছোঁয়ায় স্মার্ট সেবা

চট্টগ্রামের পাসপোর্ট অফিসে একদিন...

সরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগ নতুন কিছু নয়।  আর সেটা যদি হয় পাসপোর্ট অফিসের মতো ব্যস্ততম ও গুরত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থা!  সাধারণ মানুষ তো বটে শিক্ষিত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাও নিজের পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে ইতস্ততবোধ করবেন।  শংকা একটাই যদি না কোনো ঠুনকো অজুহাতে তার পাসপোর্টটি আটকে যায়।  সব পেশা এবং শ্রেণির মানুষের সে ভয় এবং ভীতি দূর করে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস।  স্পর্শকাতর সরকারি এ সংস্থাটির শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন পরিচালক মো. আবু সাঈদ।  সেবায় যোগ করেছেন নতুন মাত্রা।  নিজের কক্ষ নয়, পুরো কার্যালয় জুড়ে বৈচিত্র্য আর নান্দনিকতার ছোঁয়া।  স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ ও বিতরণ মূল কাজ হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন ভবনের দ্বিতীয় তলায়।  বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যে এক সূত্রে গাঁথা সেটা ভবনের দ্বিতীয় তলায় সারি সারি স্থিরচিত্রগুলো জানিয়ে দিচ্ছে।  সেবাগ্রহীতারা সুযোগ পেলে বিনা পয়সায় ইতিহাসকে জানার কৌতুহল মেটাচ্ছে।  শিশুদের বিনোদন চিত্তের কেন্দ্র নয় কিন্তু গড়ে তোলা হয়েছে হালকা অবয়বে হাসিখুশিতে মাতিয়ে রাখার উপকরণ।  সমাজের মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ, প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা কিংবা বয়স্ক নারী-পুরুষের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্টের আবেদন দাখিলের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।  শুধুমাত্র বিশেষ শ্রেণির মানুষ নয়, সকলের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছেন নিজের কক্ষের দুয়ার।  সে প্রমাণও হাতে-নাতে পাওয়া গেলো।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যে এক সূত্রে গাঁথা সেটা ভবনের দ্বিতীয় তলায়  স্থিরচিত্রগুলো জানিয়ে দিচ্ছে। ছবি দেশ বর্তমান

নিজের ও সহধর্মিনীর ই-পাসপোর্টের আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে।  স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা একই হওয়ার সুবাদে পাসপোর্টের আবেদন জমা পড়ে মনসুরাবাদে।  অনলাইনে নিজে আবেদন করতে গিয়ে একটি ভুল করে ফেলি।  ভুলটি আমার কাছে সাধারণ হলেও পাসপোর্ট অফিসের কর্তারা যদি বড় করে দেখেন।  খোঁড়া অজুহাতে পাসপোর্ট যদি আটকে যায়।  এ অস্থিরতায় আবেদনের প্রিন্ট নিয়ে ভুল সংশোধনের জন্য পাসপোর্ট অফিসে যাই।  তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটার দিকে হেলে পড়েছে।  নীচে দীর্ঘ লাইন।  দাঁড়িয়ে থাকার ঝামেলা এড়াতে সোজা ওঠে গেলাম দ্বিতীয় তলায়।  এখানে পরিচালক ও সহকারী পরিচালকের দপ্তর। এর আগে পাসপোর্টের কাজে যাওয়া হয়নি এ অফিসে।

দ্বিতীয় তলায় পরিচালকের কক্ষে প্রবেশের আগে ইতস্ততবোধ করছিলাম।  কারণ ওই সময় তার কক্ষের দরজার সামনে পিয়ন কিংবা গার্ড কাউকে দেখিনি।  এদিক-ওদিক তাকানোর পর কারো দর্শন না পেয়ে ভবনের দ্বিতীয় তলায় এ পাশ থেকে ওপাশ পাইচারী করতে চোখে পড়লো দৃষ্টিনন্দন নানা ছবি ও মানচিত্র।  দ্বিতীয় তলার বামপাশে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’।

বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সদস্য, মাওলানা ভাসানী, জাতীয় চার নেতা, ইন্দিরা গান্ধী, নিয়াজীর আত্মসমর্পণ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ও জাতিসংঘে ভাষণসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধানের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতসহ বর্তমান প্রজন্মের জন্য নানা দুর্লভ ছবি ও ঐতিহাসিক দলিল।  পেশাগত কারণে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হলেও ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’-কে এভাবে ফুটিয়ে তোলার দৃশ্য চোখে পড়েনি।  এক পলকে বঙ্গবন্ধু কর্ণারের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম।  পাসপোর্টের ভুল সংশোধন করতে গিয়ে বিনা পয়সায় ‘ইতিহাস’ সম্পর্কে জ্ঞান আহোরণ মন্দ না।

প্রায় দশ মিনিটের মতো দ্বিতীয় তলায় ঘোরাঘুরি করার পর দরজা খুলে সোজা ঢুকে গেলাম পরিচালক মো. সাঈদের কক্ষে।  তার মুখোমুখি সবগুলো চেয়ারে লোকজন। কয়েকজন দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।  সামনের চেয়ারে বসার জায়গা না পাওয়ায় একটু দূরে সাজিয়ে রাখা সোফায় শরীর এলিয়ে বসলাম।  পরে একটি চেয়ার খালি পেয়ে বসতে এক ভদ্র মহিলা বলে ওঠলেন ‘মাহবুব ভাই, ক্যামন আছেন’।  ভদ্র মহিলা আমার পেশাগত জীবনের একজন সহকর্মী।  পুরনো সহকর্মীর সাথে কুশলাদি বিনিময় করার পর পরিচালককে আমার সমস্যার কথা খুলে বললাম। নিজের ব্যক্তিগত কাজে গিয়ে পেশাগত পরিচয় তখনও দিইনি।  প্রয়োজন হয়নি বিধায় তার সাথে আমার আগে কখনও পরিচয় হয়নি।

সেবা প্রদানে ব্যস্ত বিভাগীয় পরিচালক মো. আবু সাঈদ‘র কক্ষ

জানতে চাইলেন, দুটি আবেদনের মধ্যে অন্যটি কার।  নিজের স্ত্রীর বলার পর এসেছে কিনা জানতে চাইলেন।  তাকে বললাম, ভাই আমি তো অনলাইনে আবেদন করতে গিয়ে ৪৮ পৃষ্ঠার দশ বছর মেয়াদী পাসপোর্টের জন্য পাঁচ হাজার ৭৫০ টাকা পরিশোধ করেছি কিন্তু অনলাইনে অসাবধানবশত ‘পাঁচ বছর’ সিলেক্ট করেছি।  এটি কিভাবে সংশোধন করতে হবে তা জানতে এসেছি।  দুইজনের একই অবস্থা।  স্ত্রীকে নিয়ে আসেনি, আপনি বললে আসার জন্য বলতে পারি।  পরিচালকের অনুমতি পাওয়ার পর পাঁচটার পূর্বে স্ত্রী এসে হাজির।  ইন্টারকমে নীচতলার ১০৫ নং রুমে কাকে যেন বলে দিলেন আমাদের দুই জনের কথা। এ যেন না চাইতে পাওয়া! সমস্যার সমাধান করে দিলেন কলমের এক খোঁচায়।  লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা ছাড়াই স্বল্প সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট আবেদনের সংশোধন, এনরোলমেন্টসহ আনুষঙ্গিক কাজ সেরে ফেললাম।

পরিপাটি, সাজানো-গোছানো একটি কক্ষ। কক্ষের দুই পাশে বসার জন্য আরামদায়ক কেদারা। একদিকে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো আছে স্যুট আর টাই। আলাপচারিতায় জানা গেলো বীর মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক মানুষ, প্রতিবন্ধী, বিশেষ পেশা ও শ্রেণির মানুষের জন্য এটি করা হয়েছে।  এর পাশে পরিপাটি আরেকটি কক্ষ।  ছোট্ট খাট, সোফা, বাচ্চাদের নানা খেলনা-একটি মিনি বিনোদন চিত্ত।  কক্ষটির নাম দেওয়া হয়েছে বেবি কেয়ার ও বেবি ফিডিং কর্ণার।  নান্দকিতার ছোঁয়ায় যেন স্মার্ট সেবা।

অন্য একদিন সরেজমিনে দেখি একই একই চিত্র।  পরিচালকের কক্ষে সেবাগ্রহীতাদের ভীড়।  আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর একটি এজেন্টের এক বয়স্ক বীমা কর্মকর্তা এলেন জটিল সমস্যা নিয়ে।  ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী হজ্জ্বে যাবেন।  তাদের আগে এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) ছিলো।  সেটি হারিয়ে গেছে। কোনো ফটোকপি কিংবা অন্য কোনো ধরনের রেকর্ডপত্র নেই।  এমনকি পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার পর জিডিও করেনি।  পাসপোর্টের নাম্বার না থাকায় থানা পুলিশ জিডি নেয়নি, ভদ্রলোক অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বললেন।  সেবাগ্রহীতার সাথে আলাপচারিতায় পরিচালক খুঁটিনাটি জেনে নিলেন।  পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিষয়গুলো যৌক্তিক বলে মনে হলো।  এক পর্যায়ে ভদ্রলোক বললেন, পূর্বের পাসপোর্টে যে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছিলো সেটি জানা আছে। এগারো ডিজিটের মোবাইল নম্বর দিয়ে ভেরিফাই করে জানা গেলো ভদ্রলোকের পুরনো পাসপোর্ট নম্বর।  হাসিমুখে সেবা নিয়ে ত্যাগ করলেন পরিচালকের কক্ষ।

নতুন-পুরনো, সাধারণ কিংবা অসাধারণ সব শ্রেণির মানুষের জন্য হালকা অ্যাপায়ন তার দপ্তরের স্বাভাবিক একটি দিক।  মাঝে-মধ্যে মা-বাবার সঙ্গে আসা শিশুদের হাতে চকলেটও তুলে দিচ্ছেন। কয়েকজন বয়স্ক মহিলাকে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজ উদ্যোগে পাসপোর্টের এনরোলমেন্টের কাজ সম্পাদনের চিত্রও লক্ষ্য করা গেছে। তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার সেবা।  অনেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ভোগান্তি এড়াতে দ্বারস্থ হচ্ছেন পরিচালকের দপ্তরে,নিরাশও করছেন না। জানিয়ে দিচ্ছেন, পাসপোর্ট অফিস হয়রানী কিংবা ভীতির জায়গা নয়।  সে প্রমাণ পাওয়া গেলো দুই দিনের সরেজমিন পরিদর্শনে।কারো ফাইলে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্রের ঘাটতি থাকলে তা বুঝিয়ে দিয়ে পরবর্তীতে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।  কারো আবেদনে সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া গেলে কোথায় যেতে হবে তার দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।  সেবাগ্রহীতাদের সাথে আলাপচারিতায় মনসুরাবাদ পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মো. আবু সাঈদ অবাঞ্চিত লোকের শরনাপন্ন না হওয়ার পরামর্শ দিলেন।

বিভাগীয় অফিসের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শনে দেখা যায়, সেবাগ্রহীতাদের সেবা সহজীকরণে এবং অবাঞ্ছিত লোকের শরনাপন্ন না হওয়ায় জন্য নানা দিক-নির্দেশনামূলক প্রচারপত্র।  সেবা প্রত্যাশীদের সেবা সহজীকরণের লক্ষে সেবা নির্দেশনা বোর্ড স্থাপন, পূরণকৃত নমুনা ফরম প্রদর্শন, ই-পাসপোর্ট আবেদন কিভাবে পূরণ করতে হয় তার ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভিআইপি এবং নবজাতকের জন্য প্রিমিয়াম সার্ভিস, সিনিয়র সিটিজেন, দশ বছর কম বয়সী শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তির জন্য অগ্রাধিকার সেবা, চলাচলে অক্ষম ব্যক্তির জন্য হুইল চেয়ার, পুরো ভবনজুড়ে সৌন্দর্যবর্ধন পাসপোর্ট অফিসকে করেছে আরও নান্দনিক।
চাহিত জনবল পাওয়া গেলে সেবা প্রত্যাশীদের আরও সন্তোষজনক সেবা এবং পাসপোর্ট অফিসকে একটি স্মার্ট অফিসে গড়ে তোলা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেছেন পরিচালক মো. আবু সাইদ।

তিনি জানান, চারতলা ভিতের এ ভবনটি বর্তমানে তিন তলা।  প্রায় তিন কোটি ব্যয়ে চার তলায় সম্প্রসারণের কাজ শেষ পর্যায়ে।বয়স্ক ও বিদেশিদের সুবিধার্থে একটি লিফট স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।  প্রতি বছর কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ভালো কাজের স্বীকৃতি স্মারক ও সম্মননা প্রদানের মাধ্যমে কাজে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।