নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মানে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ১২ গুণ। নানা কারণে বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকায়। গত ৯ বছরে কয়েক দফা নকশা বদল, একাধিকবার সম্ভাব্যতা যাচাই,নির্মাণ সামগ্রীর চড়া মূল্য এবং সেতুর উচ্চতা বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ।
সেই কবেকার কথা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম তখন দুইভাগে বিভক্ত। কর্ণফুলী নদীর কারণে ছিল এই বিভক্তি। দক্ষিণ পাড়ের মানুষ শহরে আসা যাওয়া করতো নৌ-পথে চাক্তাই, সদরঘাট, অভয়মিত্র ঘাটসহ কিছু নৌ-ঘাট ব্যবহার করে। ব্রিটিশরা সৈন্য চলাচল এবং তাদের পণ্য পরিবহনসহ সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ১৯৩১ সালে স্থাপন করেন কালুরঘাট সেতু। এই সেতুতে মোটর চালিত যানবাহন এবং রেল এই দু’টাই চলাচল করে আসছে। তবে একসাথে নয় এবং সিঙ্গেল লেনে অর্থাৎ ওয়ানওয়ে সিস্টেমে। মূলত এই কালুরঘাট সেতুর মধ্যে দিয়েই চট্টগ্রাম মূল শহরের সাথে জুড়ে যায় দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল।
তৎকালীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্রিটিশরা এই সেতুর আয়ুস্কাল বেধে দিয়েছিল ৫০ বছর। এই সেতুর মেয়াদ পেরিয়ে গেছে বহু বছর আগে। আর মাত্র ৭ বছর পর এটি শতবর্ষে পদার্পণ করবে। ভগ্ন, নড়বড়ে, জরাজীর্ণ অবস্থায় বর্তমানে এই সেতু চলাচলের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জোড়াতালি দিয়ে তবুও চলছে, অথবা বলা যায় জোর করে চালানো হচ্ছে।
ইতোমধ্যে কর্ণফুলী নদীর দুইপাড়কে এক করতে আরো দুটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় সেতুটি ছিল লোহার স্ট্রাকচারে উপর কাঠের পাটাতনের তৈরী। তৃতীয় সেতু উদ্বোধনের পরে অবশ্য দ্বিতীয় সেতুটি সম্পূর্ণ খুলে ফেলা হয়। এরই মধ্যে কর্ণফুলী নদীর পানি অনেকদূর গড়িয়েছে।দেশে দক্ষিণ-পূর্ব অংশের সাথে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগের বৃহত্তর স্বার্থে আরেকটি সেতুর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে দেখা দেয়। বিশেষ করে ট্রান্স এশিয়া কানেক্টিভিটির অংশ হিসেবে কর্ণফুলী নদীর উপর রেল লাইনসহ আরেকটি সেতুর প্রয়োজন এখন সময়ের দাবি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখেই রেল লাইনসহ আরেকটি সেতুর উদ্যেগ গ্রহণ করা হয়। ২০১৪ সালে সরকার বর্তমানের সিঙ্গেল লেনের রেল ও সড়ক ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন সেতু নির্মান করার উদ্যেগ নেয়।
এরপর শুরু হয়ে যায় এই সেতু নিয়ে প্রাক সমীক্ষা, সম্ভাব্যতা যাচাই,ব্যয় সংকোচন-ব্যয় বৃদ্ধি, মন্ত্রণালয়ে ফইল চালাচালি ইত্যাদি, নানা জটিলতায় এসব ঘুরপাক খাচ্ছে। কালুরঘাটে নতুন কর্ণফুলী সেতু নির্মাণ নিয়ে সবচে বেশি সোচ্চার ছিলেন জাসদ নেতা ও বোয়ালখালী এলাকার সংসদ সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদল।তার মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হলে মোছলেমউদ্দিন উপ-নির্বাচনে পরবর্তী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নতুন সেতুর দাবি নিয়ে তিনিও তাঁর পূর্বসূরীর মতোই সোচ্চার ছিলেন।
তিনিও চির বিদায় নিয়েছেন। এখনো চলছে নানান জটিলতার ঘুরপাক। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন নির্মান কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই লক্ষে দোহাজারী পর্যন্ত পুরাতন রেল লাইন নতুন আঙ্গিকে সংস্কার করা হয়েছে। কিন্ত নতুন কালুরঘাট সেতু প্রকল্প এখনো জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় ক্ষেপণ হচ্ছে,নেই তেমন কোন অগ্রগতি। অগ্রগতি বলতে যেটুকু হয়েছে, তা হচ্ছে সেতু প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ১২গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এটি নির্মানে খরচ হবে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
২০১৪ সালে গৃহিত এই নতুন সেতুর নির্মাণ উদ্যেগের পর থেকে একাধিকবার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। সেতুর নকশা বদল করা হয়েছে কয়েক দফা। এসব করতে করতে এভাবে কেটে গেছে ৯বছর। রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে একটি সিঙ্গেল লেন রেল লাইন এবং ডাবল লেন সড়ক সেতুর জন্য একটি ডিপিপি বা বিশদ প্রকল্প প্রস্তাব তৈরী করা হয়েছিল। সেই ডিপিপি অনুযায়ী এর জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১হাজার ১৬১ কেটি ২৭ লাখ টাকা। বর্তমানে এই সেতু নির্মাণে খরচ হবে ১৪ হাজার কোটি টাকা। নতুন পরিবর্তিত সেতুতে সিঙ্গেল লেনের পরিবর্তে থাকবে ডাবল লেনের ডুয়েল গেজ রেল লাইন এবং ডাবল লেনের সড়ক পথ।
নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণ শেষ করতে সময় ধরা হয়েছে ২০২৮ সাল। দফায় দফায় নকশা পরিবর্তন, একাধিকবার সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াও প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির জন্য কর্তৃপক্ষ আরো কিছু কারণ চিহিৃত করেছে। এগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী নদীতে নৌযান চলাচলের জন্য সেতুর উচ্চতা বৃদ্ধি (ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স), নির্মান সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি অন্যতম। ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া এইনতুন সেতু নির্মাণে অর্থ সহায়তা (ঋণ) দিতে সম্মতি জানিয়েছে।
জানা গেছে, নতুন সেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়েকে পুরাতন কালুরঘাট সেতুটি মেরামত সাপেক্ষে চালু রাখতে হবে। এর জন্য রেলওয়েকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।