চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণ কাজ বর্তমানে ৯৬.৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আর মাত্র ৩.৫ শতাংশ কাজ বাকি। এখন টানেলের ভেতর যান্ত্রিক নানা বিষয়ের কাজ চলছে। এসব কাজ শেষ হতে মে মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ। নির্মাণ কাজ শেষ হলে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে ছুটবে গাড়ি। চট্টগ্রামবাসী অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন চার লেনবিশিষ্ট দেশের প্রথম এই টানেল চালু হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণের।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন টানেলের ভেতর ভেন্টিলেশন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, অগ্নিনির্বাপণ, পানি নিষ্কাশন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, কমিউনিকেশন ও মনিটরিং সিস্টেম ইনস্টল করার কাজ চলছে। এই কাজগুলো শেষ হলে টানেল গাড়ি চলাচলের উপযোগী হবে।
কবে নাগাদ প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ হবে-জানতে চাইলে টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘টানেলের দুই প্রান্তের সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে টানেলের ভেতর সাত ধরনের টেকনিক্যাল কাজ চলছে। আশা করছি, এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে এসব কাজ শেষ হবে। এরপর সরকার এটি উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নেবে।’
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি অর্থ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে এই ঋণ দিয়েছে।
টানেলটি পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির নিকট হতে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে। নদীর তলদেশে টানেলের মূল পথের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। সর্বনিম্ন ৩৬ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ ফুট গভীরে স্থাপন করা হয়েছে দুটি সুড়ঙ্গ। প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। ১১ মিটার ব্যবধানে নির্মিত দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। এই টানেল দিয়ে যানবাহন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে।
মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম প্রান্তে (পতেঙ্গা) ০.৫৫০ কিমি ও পূর্ব প্রান্তে (আনোয়ার) ৪.৮ কিমিসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। এ ছাড়াও আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল সড়ক) রয়েছে। নিরাপদে গাড়ি চলাচলের জন্য টানেলের উভয় প্রান্তে স্ক্যানার বসানো হয়েছে। এরই মধ্যে টানেলের ভেতর গাড়ি চলাচলে টোল চূড়ান্ত হয়েছে।
টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে পরিচালিত জরিপ অনুসারে, দিনে প্রায় ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি চলতে পারবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন যাতায়াত করতে পারবে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল সুড়ঙ্গ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে।
প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি স্টাডি হয় ২০১৩ সালে। তখন প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে খরচ বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা করা হয় এবং প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সর্বশেষ সংশোধিত বাজেটে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যয় প্রায় ৩১৫ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু টানেল যোগ করবে নতুন মাত্রা। টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। এই টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে উঠবে ‘এক নগর, দুই শহর। এ রকম নগরীর দেখা মেলে চীনের সাংহাইয়ে। দেশটির সবচেয়ে বড় ও জনবহুল নগরী সাংহাই পরিচিত ‘ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে। এই শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রকে দুই ভাগে ভাগ করেছে চ্যাং জিয়াং নদীর উপনদী হুয়াংপু-যে নদীতে নির্মিত টানেল যুক্ত করেছে দুই তীরকে। সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রাম নগরী থেকে আনোয়ারা উপজেলাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কর্ণফুলী নদী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ যত এগিয়েছে ততই স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা। গত চার বছরে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্ট, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্য তেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত ৮০টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে।
অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ ইতিমধ্যেই কারখানা গড়ে তোলার চিন্তা থেকে কিনে রেখেছেন আগাম জমি। সবমিলিয়ে কর্ণফুলী টানেল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ল্যান্ডস্কেপে আনছে বড় ধরনের পরিবর্তন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে দেশের নতুন বিজনেস হাব।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দেশের প্রথম টানেলটি এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। টানেলটি চালু হলে এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের জন্য গেম চেঞ্জার হবে, যা দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযোগ সমস্যার সমাধান করবে।’