গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাজ হলো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থানা পুলিশকে সহায়তা দেওয়া। এর পাশাপাশি নগরে কিংবা জেলায় বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তদন্ত করে সংস্থাটি। অভিযান পরিচালনার জন্য গোয়েন্দা পুলিশকে নগর কিংবা জেলার পথঘাট চেনা-জানা থাকতে হয়। অন্যথায় অভিযানে হিমশিম খেতে হয় গোয়েন্দাদের। এমন দশায় পড়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) ইউনিট। পথঘাট চেনা-জানা না থাকায় চট্টগ্রাম শহরের অপরাধ দমনে পিছিয়ে পড়েছে সিএমপির ডিবি ইউনিট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিএমপির ডিবিতে এখন যেসব কর্মকর্তা আছেন, তারা প্রায় সবাই নতুন। কেউ ৬ মাস, আবার কেউ ২ মাস ধরে কর্মরত আছেন। দুয়েকজন ছাড়া অভিজ্ঞ কোনো কর্মকর্তা নেই। নতুন কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম শহরের পথঘাটই চেনেন না। নগরীতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, এর কারণ উদঘাটন করতেই হিমশিম খাচ্ছেন এসব কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম শহরের পরিস্থিতি নখদর্পণে রেখে অপরাধ দমন করতে পারেন, এমন কর্মকর্তা এখন ডিবিতে নেই বললেই চলে।
যে কারণে গত কয়েক বছর ধরে সিএমপির ডিবি ইউনিটের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। নগরীতে এখন স্পর্শকাতর কোনো অপরাধের ঘটনা তদন্তে ভূমিকা রাখতে পারছে না সংস্থাটি। নগরীতে এখন অপরাধের ঘটনা তদন্তে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এতে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে ডিবি।
কাগজে-কলমে সিএমপির ডিবি ইউনিটের চারটি জোন থাকলেও কার্যক্রম চলছে দুই ভাগে। উত্তর ও দক্ষিণ মিলে একটি জোন এবং পশ্চিম ও বন্দর মিলে অপর জোন।
উত্তর ও দক্ষিণ জোনের দায়িত্বে আছেন একজন উপকমিশনার (ডিসি) ও একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি)। তবে এই জোনে কোনো সহকারী কমিশনার নেই। এ ছাড়া পরিদর্শক আছেন ৬ জন, এসআই আছেন ১১ জন, এএসআই আছেন ১৭ জন এবং কনস্টেবল আছেন ৩০ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই জোনের ডিসিসহ বেশিরভাগ কর্মকর্তা কয়েকমাস আগে যোগ দিয়েছেন। ডিসি নিহাদ আদনান তাইয়ান যোগ দিয়েছেন তিন মাস আগে। ছয়জন পরিদর্শকের মধ্যে ৫ জনই যোগ দিয়েছেন ৫ মাস আগে।
ডিবির পশ্চিম ও বন্দর জোনেরও দায়িত্বে আছেন একজন উপকমিশনার (ডিসি), একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি)। এই জোনেও কোনো সহকারী কমিশনার নেই। এ ছাড়া পরিদর্শক আছেন ৬ জন, এসআই আছেন ১০ জন, এএসআই আছেন ১৭ জন এবং কনস্টেবল আছেন ৩৭ জন। এদের মধ্যে এডিসিসহ বেশিরভাগ কর্মকর্তা ৬-৭ মাস আগে যোগ দিয়েছেন। ছয়জন পরিদর্শকের মধ্যে ৫ জনই যোগ দিয়েছেন ৬ মাস আগে।
জানতে চাইলে সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আ স ম মাহতাব উদ্দীন দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘ডিবিতে আগে যারা অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ছিলেন তারা তো একদিনে অভিজ্ঞ হয়নি। এখন নতুন যারা কর্মকর্তা আছেন তারাও এক সময় অভিজ্ঞ হয়ে যাবে।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডিবির কর্মকর্তাদের পথঘাট চেনাটা জরুরি না। তারা পথঘাট চিনলে সমস্যা আছে। না চেনাটাই ভালো। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীকে খুঁজে বের করা যায়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবির একজন সাবেক কর্মকর্তা দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘কেবল প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে অভিযান পরিচালনা করা যায় না। কারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট টার্গেটে পৌঁছানো যায় না। ট্র্যাকিং করে একজন অপরাধীর ১০০ থেকে ২৫০ গজ সীমানার মধ্যে পৌঁছানো যায়। এরপর কৌশলে ওই জায়গা থেকে অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হয়।’
জানতে চাইলে ডিবি বন্দর ও পশ্চিম জোনের দায়িত্বে থাকা ডিসি মুহাম্মদ আলী হোসেন দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘ডিবিতে এখন যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন তারা এখানে নতুন এসেছে। আর একটা নতুন জায়গায় এসে রাতারাতি তো পথঘাট চেনা-জানা হয়ে উঠে না। পথঘাট না চিনলে অভিযানে সমস্যা হয়। এটা সত্য, অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি অপরাধীর কাছে পৌঁছানো যায় না। ওই রকম প্রযুক্তি বাংলাদেশে এখনো আসেনি। আমি যতটুকু জানি, এই প্রযুক্তি আছে কেবল মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছে।’
ডিবি উত্তর ও দক্ষিণ জোনের দায়িত্বে থাকা ডিসি নিহাদ আদনান তাইয়ান দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘নতুন কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞ হতে একটু সময় লাগবে। যত দিন যাবে অভিজ্ঞতা ততো বাড়বে। আমি নিজে প্রথম একমাস পর্যন্ত কোনো তথ্য পাইনি। এখন আস্তে আস্তে পাচ্ছি।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে ১০ বছর আগের সেটআপ আর একবছরের সেটআপ তো সমান হবে না। আর কোনো কর্মকর্তা একটা জায়গায় ৫-৭ বছর থাকলে বিচ্যুতি ঘটে, একটা পক্ষের প্রতি প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তাই পুরনো কর্মকর্তাদের শুদ্ধিকরণের জন্য বদলি করা হয়।’
২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর নগরীর সিমেন্ট ক্রসিং আকমল আলী রোডের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় ৫ বছর বয়সী আয়াত। তারপর নানান জায়গায় খুঁজেও তার সন্ধান পায়নি পরিবার। পরে ইপিজেড থানায় জিডি করে তার পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিশু আয়াতের নিখোঁজ রহস্য উদঘাটনে প্রথমে ছায়া তদন্তে নেমেছিল ডিবি পুলিশ। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে তাদের তদন্ত আটকে যায়। এরই ফাঁকে ছায়া তদন্তে নামে পিবিআই। যেখানে ডিবির তদন্ত আটকে গিয়েছিল, সেখানে সফল হয় পিবিআই। পরে ৩০ নভেম্বর আয়াতের দেহের খন্ডিত অংশ খাল থেকে উদ্ধার করে পিবিআই, যা সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
গত ২১ মার্চ নগরীর পাহাড়তলী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন আবিদা সুলতানা আয়নী নামে ১০ বছর বয়সী এক কন্যাশিশু। শিশুটির খোঁজে থানায় ধর্ণা দিয়েও কোনো প্রতিকার না পেয়ে পরে আদালতে অপহরণের মামলা করেছিলেন তার মা। ঘটনাটির রহস্য উদঘাটনে ছায়া তদন্তে নামে পিবিআই। তারা প্রথমে এ ঘটনায় অভিযুক্ত সবজি বিক্রেতা মো. রুবেলকে (৩৫) আটক করে। এরপর গত ২৯ মার্চ পাহাড়তলী থানার সাগরিকা মুরগি ফার্ম পুকুর পাড় এলাকা থেকে শিশু আয়নীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পিবিআই।
ঈদকে সামনে রেখে নগরীতে এখন ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতাও। কিন্তু এসব অপরাধ দমনে ডিবি পুলিশ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
আজ থেকে ৭ বছর আগে চট্টগ্রাম নগরীতে স্পর্শকাতর কোনো অপরাধ ঘটলে ঘটনাস্থলে ছুটে যেতেন ডিবির কর্মকর্তারা। সূত্রবিহীন চাঞ্চল্যকর ঘটনা থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ ও খুনের ঘটনা দ্রুত সময়ের মধ্যে রহস্য উন্মোচন করে ফেলতেন তৎকালীন ডিবির চৌকস কর্মকর্তারা।
২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সিএমপির ডিবি ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন এডিসি বাবুল আক্তার। অপরাধ দমন এবং সূত্রবিহীন ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পারদর্শী কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন তিনি। এই কর্মকর্তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন চট্টগ্রাম শহরের অপরাধীরা। এ সময় ডিবির আরও চার দক্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। তারা হলেন-এডিসি এস এম তানভীর আরাফাত, এস আই সন্তোষ কুমার চাকমা, এসআই জহির ও এসআই রাজেশ।
২০১৭ সালে এসব অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তারা সিএমপি ছাড়ার পর ডিবির কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। এর পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিএমপিতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলাকালে ডিবির অনেক অভিজ্ঞ পরিদর্শক ও এসআইকে বদলি করা হয়। ডিবিতে এখন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তা খুব একটা নেই। অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তার অভাব থাকায় অপরাধ তদন্তে পিছিয়ে পড়েছে ডিবি। এতে সুযোগ নিচ্ছে পিবিআই।
জানতে চাইলে ডিবি বন্দর ও পশ্চিম জোনের দায়িত্বে থাকা ডিসি মুহাম্মদ আলী হোসেন দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘গত বছর সিমেন্ট ক্রসিং আকমল আলী রোডের বাসা থেকে শিশু আয়াতের নিখোঁজের ঘটনায় প্রথমে ছায়া তদন্তে নেমেছিল ডিবি। তদন্তে নৌবাহিনী ঈশা খাঁ গেটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নৌবাহিনী ডিবিকে সেই ফুটেজ দেয়নি। যে কারণে আমরা তদন্ত আটকে গিয়েছিলাম। অথচ নৌবাহিনী পরে পিবিআইকে সেই ফুটেজ সরবরাহ করেছে। পিবিআই ফুটেজটি পেয়ে খুনিকে গ্রেপ্তার করে।’
প্রশ্নের জবাবে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সবাই তো আর বাবুল আক্তার হতে পারবে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি। আরেকটা বিষয় হলো, আমি প্রতিযোগিতামূলক কাজ করি না। কোনো ঘটনার তদন্তে যখন দেখি পুলিশ কিংবা পিবিআই কাজ করছে, তখন আমরা আর সেদিকে পা বাড়াই না। কারণ পিবিআই, ডিবি ও পুলিশ একই ফোর্স।’