চট্টগ্রামের পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প পঁচাত্তর বছরের পুরনো ঐতিহাসিক স্থাপনা। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে পানিপথে হজ গমনের লক্ষে সারাদেশের হাজিদের প্রাণকেন্দ্র ছিলো এটি। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়েও হাজী ক্যাম্পে প্রাণচঞ্চল পরিবেশ ছিল। রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী সব কার্যক্রম রাজধানীমুখী হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রাণ হারিয়ে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প এখন পরিত্যক্ত এক মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছে।
আট বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজী ক্যাম্পে বিভাগীয় হজ অফিস ও আান্তর্জাতিক মানের সম্মেলন কেন্দ্র গড়ে তোলার ঘোষণা দিলেও তা পড়ে আছে হিমাগারে। চট্টগ্রামে হাজীদের হয়রানি বন্ধ এবং সামনে পানিপথে হজযাত্রার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন চান সংশ্লিষ্টরা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৮ সালে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের অস্থায়ী সরকার কলকাতা হতে ‘পোর্ট হজ কমিটি’ চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম হাইস্কলে স্থানান্তর করে অস্থায়ীভাবে। ‘পোর্ট হজ কমিটি’-এর নাম পরবর্তন করে রাখা হয় ‘পোর্ট হজ অফিস’। পরে ১৯৪৯ সালে নগরের পাহাড়তলীতে ৯.৩৫ একর জায়গা অধিগ্রহণপূর্বক তৎসময়ে ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় হজক্যাম্প। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এ হজক্যাম্পটি ছিলো তদানিন্তন একমাত্র হজ অফিস। ১৯৫১ সাল হতে সামুদ্রিক জাহাজযোগে পাহাড়তলী হজক্যাম্প থেকে হজ অপারেশন শুরু হয়। ওই সময় পাকিস্তানের করাচি থেকে বিমানযোগে একমাত্র হজ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। হজযাত্রী কল্যাণ পরিষদের মহাসচিব বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক অধ্যক্ষ ডা. আবদুল করিমের সাথে কথা বলে জানা যায়, তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান আমলে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পের সামনে ডি.টি. রোডের দুই পাশে বিকিকিনির হাট বসতো। বেচাকেনায় সরগরম ছিলো এলাকাটি।
স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প থেকে শুধুমাত্র পানিপথে হজযাত্রী পরিবহন করা হলেও এর পরের বছর থেকে পানিপথের পাশাপাশি আকাশপথেও হজযাত্রী পরিবহন শুরু হয়। এজন্য ঢাকার তেজগাঁও পুরাতন বিমাবন্দরে অস্থায়ী হজক্যাম্প স্থাপন করে সেখান থেকে হাজি পাঠানো শুরু হলে পাহাড়তলী হজক্যাম্পের গুরত্ব কমে যায়।
জানা যায়, সামুদ্রিক জাহাজের অপ্রতুলতার অজুহাত দেখিয়ে ১৯৮৫ সাল থেকে হজযাত্রা বন্ধ করে দিয়ে সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক করলে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পে কর্মচাঞ্চল্যের পরিবর্তে নেমে আসে সুনশান নীরবতা। তৎকালীন সরকার মূলত ১৯৮৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পের যাবতীয় কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলে ঢাকায় স্থানান্তর করে। যার কারণে হাজী ক্যাম্পের মূল্যবান জিনষিপত্রসহ শতকোটি টাকার সম্পদ বিরানভূমিতে পরিণত হয়। এ জায়গার ওপর দৃষ্টি পড়ে অনেকের। পরিত্যক্ত হাজী ক্যাম্পে প্রাইভেট আইসিডি গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনাও পেয়ে বসে অনেকের। কিন্তু সরকার সায় দেয়নি। বর্তমানে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হলেও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ হাজির হজে যেতে হয় ঢাকা দিয়ে। এতে হাজিদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। পরিবার পরিজন নিয়ে হজে যাওয়া হাজিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় বেশি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, হজক্যাম্পের ৯.৩৫ একরের মধ্যে ২০০৩ সালে এক একর জায়গায় ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় স্থাপন করার জন্য হস্তান্তর করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। ২০১০ সালের ১ আগস্ট কার্যালয় দুটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হাজী ক্যাম্পের সম্পত্তি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে স্থায়ী বরাদ্দের আবদার করলে ধর্ম মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম বিভাগের হজযাত্রীদের স্বার্থ বিবেচনা করে অপারগতা প্রকাশ করে। পরবর্তীতে হাজী ক্যাম্পের সবকটি ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় ২০১৪ সালে সব ধরনের অবকাঠামো পরিত্যক্ত ঘোষণা করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
হাজী ক্যাম্পের অবকাঠামো সংস্কারসহ বিভাগীয় হজ অফিস চালুর জন্য চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো। এজন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক আহমদুল ইসলাম চৌধুরী ও বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক অধ্যক্ষ ডা. আবদুল করিমের নেতৃত্বাধীন ‘হজ্বযাত্রী কল্যাণ পরিষদ’। সংস্থাটি চট্টগ্রাম বিভাগের হজ্বযাত্রীদের চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সরাসরি হজ ফ্লাইটের জন্য শুরু থেকে সোচ্চার ছিলো। তাদের প্রধান দাবি ছিলো পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পটি পূণরায় চালু করা। এতে ঢাকার উপরও চাপ কমবে। পাশাপশি ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম নগরের মহাসচিব ও হজযাত্রী কল্যাণ সংস্থা-বাংলাদেশের ব্যানারে সংস্থাটির চেয়ারম্যান এইচ এম মুজিবুল হক শাকুরও পাহাড়তলী হজক্যাম্প পুনঃনির্মাণের দাবিতে সোচ্চার ।
বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ এবং সরকারি মহলের কাছে চিঠি চালাচালির প্রেক্ষিতে পাহাড়তলী হজক্যাম্প পূনরায় চালুকরণ এবং হজক্যাম্পের ব্যবহারযোগ্য ভবনসমূহ সংস্কার ও একটি আধুনিক সম্মেলন কেন্দ্র স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পক্ষে নীতিগতভাবে সম্মতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিষয়টি জানা যায়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান শেখ শামসুর রহমান স্বাক্ষরিত ২০১৬ সালের ২৭ জুন ঢাকার আশকোন হজ অফিসের পরিচালকের কাছে প্রেরিত এক পত্রে। পত্রে চট্টগ্রাম বিভাগের হজযাত্রীদের জন্য পাহাড়তলী হজক্যাম্পে বিদ্যমান অবকাঠামো ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ একটি প্রকল্প প্রস্তাব প্রেরণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আশকোন সহকারি হজ অফিসার (পরিচালকের দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. আবদুল মালেক স্বাক্ষরিত একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি বরাবর পত্র ইস্যু করা হয়। উক্ত পত্রে হজক্যাম্পের বিভিন্ন দালানের সংস্কার ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার লক্ষে গণপূর্ত ও স্থাপত্য অধিদপ্তর কর্তৃক চট্টগ্রামের হজক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক নকশা প্রণয়ন করে চট্টগ্রামের গনপূর্ত ও ঢাকার হজ অফিসকে সরবরাহের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত নকশায় ছয়তলাবিশিষ্ঠ ১০টি ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। চট্টগ্রামের হজক্যাম্প পুনরায় চালুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও প্রকল্পটি এখনও আলোর মুখ দেখছে না। এ নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে হজযাত্রী কল্যাণ পরিষদের দপ্তর সম্পাদক ডা. সালেহ আহমদ সুলেমান বলেন, দেশের এক-চতুর্থাংশ হজযাত্রী চট্টগ্রাম বিভাগের। সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাহাড়তলী হজক্যাম্প পুণরায় বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। হাজী ক্যাম্প পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি দিয়ে আসছি।বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
হজযাত্রী কল্যাণ পরিষদের মহাসচিব অধ্যক্ষ ডা. আবদুল করিম দেশ বর্তমানকে বলেন, চট্টগ্রাম একটি বড় বিভাগীয় শহর। কিন্তু দুর্ভাগ্য কোনো হজক্যাম্প নেই। এজন্য পাহাড়তলী হজক্যাম্পটি চালুর জন্য আমরা বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়ে আসছি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজযাত্রীগণের কল্যাণে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প চালু করা গেলে এতদঞ্চলের হাজার হাজার হজ্বযাত্রী এবং শতাধিক হজ এজেন্সির স্টাফগণকে ঢাকা-চট্টগ্রাম দৌড়ঝাপ করতে হবে না। তিনি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের দাবি জানান।