জ্বালানি-রসদের দাম বৃদ্ধি, বৈরি আবহাওয়া ও বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের মাছ শিকারের কারণে লাগামহীন দেশের ইলিশের দাম। জেলেরা বলছেন, সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে কাঙ্খিত ইলিশ না পাওয়ায় খরচের সাথে সামঞ্জ্যসতা আনতে পারছেন না তারা। প্রতিবার সাগর থেকে লোকসানের ঘানি নিয়ে ফিরতে হয় ঘাটে। আড়ৎদার-পাইকাররা বলছেন, গত বছরের তুলনায় মাছ কম কিন্তু চাহিদা বেশি থাকায় এবার মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে ইলিশ।
বরগুনার পাথরঘাটার আবুল হোসেন ফরাজীর মালিকানাধীন এফ বি ফরাজী ট্রলার ১৮ জন জেলেসহ গত ১৬ সেপ্টেম্বর পৌনে তিন লাখ টাকার জ্বালানি-রসদ নিয়ে গভীর সাগরে ইলিশ শিকারে যায়। ১০ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর প্রায় এক মন মাঝারি আকারের (৬০০-৭০০ গ্রামের) ইলিশ ও কিছু মিশ্রিত মাছ নিয়ে পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে ফিরেন। এক মন ইলিশ ৬০ হাজার টাকা ও অন্যান্য মাছ ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তারা।
ট্রলারের মাঝি সুলতান মিয়া বলেন, সাগরে আগের মতো মাছ নাই। ১০ বার জাল ফালাইলেও মাছ পাই কম। ট্রলার মালিকের লোকসান দেখতে আমাদেরও ভালো লাগে না। কিন্তু কি করমু আমরা। একদিকে মাছ কম, আরেক দিকে বৈরী আবহাওয়া।
ট্রলার মালিক আবুল ফরাজী বলেন, চলতি ইলিশ মৌসুমে এই ট্রলার ৮ বার মাছ শিকারে গিয়ে লোকসান হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। অনেকে বলেন, ইলিশ ঘাস খায় না, খড় খায় না, খৈল-ভুষি বা ফিডও খায় না, ইলিশের জন্য চিকিৎসা খরচও নাই, ইলিশ পালতে দিনমজুরও রাখা লাগে না তারপর দাম এত বেশি কেন?
তিনি বলেন, যদি ইলিশ এসব খাইয়ে পাওয়া যেত তবে পাঙাসের থেকেও কম দামে ইলিশ খাওয়াতে পারতাম আমরা। একটি ট্রলারে ১৮ জন জেলের মাসিক বেতন ১৬-২৫ হাজার পর্যন্ত। একবার সাগরে গেলে ৮ ব্যারেল ডিজেল দরকার হয়। এরপর জেলেদের ওষুধ থেকে শুরু করে চাল-ডাল, হলুদ-মরিচসহ ১৫ দিনে অন্তত ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
দেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকার
জেলেরা জানান, ভারতীয় জেলেরা দেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। একাধিকবার মৎস্য অফিস ও প্রশাসনকে জানালেও অনুপ্রবেশ বন্ধে ব্যবস্থা নেয়নি তারা।
পাথরঘাটার এফ বি মায়ের দোয়া-৩ ট্রলারের মাঝি কাওসার হোসেন ও জেলেরা অভিযোগ করে বলেন, ভারতীয় অত্যাধুনিক ট্রলিং জাহাজ ও ট্রলার নিয়ে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকার করে। তাদের বাধা দিতে গেলে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে ভারতীয় অন্যান্য জেলেদের ডেকে এনে আমাদের জাল-দড়ি কেটে দেয়, মারধর করে। তারা একবার ওয়াকি-টকিতে বললে ৩০/৪০টি ট্রলার চলে আসে।
এফ বি নাজমা ট্রলারের মাজি ও জেলেরা বলেন, আমরা পানি দেখে অনুমান করে মাছের আশায় জাল ফেলি। কিন্তু ভারতীয় জেলেরা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে মাছের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেন। তারপর যদি দেখেন সেখানে আমাদের জাল পাতা, তাহলে তারা ট্রলিং জাহাজ দিয়ে আমাদের জাল দড়ি উঠিয়ে নিয়ে মাছ শিকার করে। আমাদের ট্রলারে পাথর নিক্ষেপ করে। নৌ-বাহিনী তাদের কিছু বলে না। আমরা তাদের তথ্য দিতে গেলে উল্টো আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে।
অবৈধ জালে মাছ শিকার
সুন্দরবনসহ আশেপাশের সব এলাকা এবং সাগরের মোহনায় খুটা জাল ব্যবহার করে কিছু অসাধু জেলেরা। এছাড়াও সাগরে চিংড়ি মাছের জাল নামে ছোট ফাসের জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন কিছু কিছু জেলেরা।
জেলেরা জানান, এসব খুটা জাল এবং ছোট ফাসের জালের কারণে ইলিশ পোনাসহ সব প্রজাতির মাছ মারা পড়ে। এ কারণে দিনের পর দিন কমছে ইলিশসহ সব প্রজাতির মাছের সংখ্যা।
দেশীয় ট্রলিং জাহাজ দিয়ে মাছ শিকার
ট্রলিং জাহাজ দিয়ে মাছ শিকারের কারনে দিন দিন কমছে ইলিশ, বাড়ছে দাম। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের তুহিন হাওলাদারের মালিকানাধীন এফ বি তুবা ট্রলারের মাঝি সার্ধুল ঠাকুর (৬৮) মাছ শিকার করেন ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। সার্ধুল ঠাকুর বলেন, এক সময়ে সাগরে মাছ আর পানি সমান ছিল। জাল ফেললেই মাছ পেতাম। কিন্তু দিনের পর দিন মাছের সংখ্যা কমছে। মাছ কমার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চট্টগ্রামের ট্রলিং জাহাজ। ইলিশ মাছ লবন পানিতে বসবাস করলেও এরা ডিম ছাড়তে আসে মিঠা পানিতে। এসব ট্রলিং জাহাজ উপকূলের কাছাকাছি এসে মশারি জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করে। মিঠা পানিতে ডিম থেকে বাচ্চা হয়ে ইলিশের পোনাগুলো যখন গভীর সাগরে যায়, তখন ট্রলিং জাহাজের মশারি জালে আটকে মারা পড়ে ইলিশ পোনা। ট্রলিং জাহাজগুলো এসব মাছ ঘাটে নেয় না, কারণ ইলিশের পোনা ধরা নিষিদ্ধ। তাই তারা ইলিশের পোনাসহ ছোট সব মাছ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে বড় মাছ নিয়ে ঘাটে যায়।
এই ট্রলারের জেলেরা জানান, এমন অবস্থা চলতে থাকলে ২-৩ বছরের মধ্যে সাগরে আর কোনো মাছ থাকবে না।
বরফ সিন্ডিকেট
জেলেদের অভিযোগ, পাথরঘাটায় বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে বরফ উৎপাদন ব্যহত হয়। তাই বরফের একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। ৮০ টাকার এক ক্যান বরফ কিনতে হয় ১৫০ টাকায়। মাসে অন্তত ৪/৫ বার বরফ সংকট হয় পাথরঘাটায়। তখন খুলনা থেকে বরফ আনতে হয়। খুলনা থেকে বরফ আনলে পরিবহন খরচসহ এক ক্যান বরফের দাম পড়ে ৬০০ টাকা। বরফের এই দাম যোগ হয় ইলিশের সাথে।
আবহাওয়ার সংকেত সঠিক সময়ে জানতে পারছেনা জেলেরা
সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে জাল ফেলতেই আবহাওয়া খারাপ। বৈরি আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে ঘাটে ফিরে আসেন জেলেরা। বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধূরী বলেন, একবার মাছ শিকারে সাগরে যাওয়া-আশা করতে অন্তত ২ লাখ টাকার ডিজেল পুড়তে হয়। কিন্তু জেলেরা সাগরে গিয়ে চলতি মৌসুমে ৭ বার ফিরে এসেছে। দেশের ২য় সর্ববৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটায়। অথচ এই জেলায় কোন আবহাওয়া অফিস নেই। এখানে পূর্ণাঙ্গ একটি আবহাওয়া অফিস থাকলে সাগরে মাছ শিকারে যাওয়ার আগেই বৈরি আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে পারতো।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবার মিটিং এ আমরা ঢাকা মৎস্য ভবনে গিয়ে নানান জটিলতার কথা তুলে ধরি লিখিতভাবে। মন্ত্রণালয়ের লোকজন থাকেন, সবাই সব কিছু জানেন, কিন্তু সমাধান হয়নি।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়ৎদার-পাইকাররা বলছেন, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের খোলা ডাকে ইলিশ বিক্রি করেন জেলেরা। আড়ৎদার-পাইকাররা মাছ কিনে বিক্রি করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে, নানান জটিলতায় বিগত বছরের থেকে এবার চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
মৎস্য অবতরন কেন্দ্রের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে এক কেজি ও তার উপরের ইলিশ মন প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ হাজার টাকা। ৮শ থেকে এক কেজির কমের ইলিশ ৬৫-৬৯ হাজার টাকা। ৬শ থেকে ৮শ গ্রামের কমের ইলিশ ৬০-৬৪ হাজার টাকা। ৪শ থেকে ৬শ গ্রামের কমের ইলিশ ৪৫-৬৩ হাজার টাকা।
অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লে. কমান্ডার জি এম মাসুদ শিকদার বলেন, সিন্ডিকেট ভেঙে ইলিশের বাজার দর ঠিক রাখতে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের অকশন শেডে খোলা ডাকে সরাসরি জেলেদের থেকে ইলিশ কিনেন আড়ৎদার ও পাইকাররা। ডাক চলাকালীন সময়ে কড়া নজড়দারি থাকে অকশন শেডে। এখানে কোন ধরনের কারসাজির সুযোগ নেই।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসিন বলেন, জেলেদের অভিযোগের বিষয়ে জানেন মৎস্য অধিদপ্তর। উর্ধ্বতনদের জানিয়েছেন তারা।
চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১১৮৪.৬৪ মেট্রিক টন মাছ বিক্রি হয়েছে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে। ২০২৩ সালে ১২৯৫.৯৫ মেট্রিক টন ইলিশ বিক্রি হয়েছে এই ঘাটে।