আইন সংশোধনেই আটকে আছে জামায়াতের বিচার

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ব্যক্তির বিচার হলেও সংগঠন হিসাবে জামায়াতে ইসালামীর বিচার হয়নি। সংগঠনটির বিচারের জন্য বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ১০ বছর ধরে ঝুলে আছে। বলা যায়, আইন সংশোধনের বেড়াজালে আটকে আছে সংগঠনের বিচার। অবশ্য এর জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকেই যথেষ্ট বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, বিদ্যমান আইনেই জামায়াত সহ অভিযুক্ত দল বা সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব। বিদ্যমান আইনে সংগঠন হিসাবে বিচারের জন্য শাস্তির বিধান না থাকলেও ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা তা নির্ধারণ করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জামায়াতের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট যথেষ্ট নয়। এই আইনটি সংশোধন করা দরকার এবং সেই সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমি এতটুকুই বলবো, এর জন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন।

২০১৪ সাল থেকে দীর্ঘসময় ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার ঝুলিয়ে রাখার বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এটা মনে হওয়াটাও তো আমাদের (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার) জন্য দুঃখের। কারণ এই সরকারই কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করেছে এবং তারা (সাজাপ্রাপ্তরা) কিন্তু জামায়াতের হোতা ছিল, প্রতিষ্ঠাতা ছিল। সেই ক্ষেত্রে আপনারা যদি মনে করেন আমরা উদ্যোগী (বিচারে) নই, তাহলে সেটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় হাইকোর্টে দলটির নিবন্ধন বাতিলের পর আপিল বিভাগে থাকা মামলাটি নিষ্পত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করবো না। কারণ এটি বিচারাধীন বিষয়। আমি বিচারাধীন বিষয়ে কখনও কথা বলি না।

মানবাধিকারকর্মী সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী জেড. আই. খান পান্না দেশ বর্তমানকে বলেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারও দ্রুত হওয়া উচিত। প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনে কালক্ষেপণের কোনো কারণ নেই। এর জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই যথেষ্ট বলে তিনি মনে করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ বর্তমানকে জানান, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত দল বা সংগঠনের বিচারের জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৭৩’ সংশোধনের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। এর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। খসড়া তৈরী হলেও আগামী নির্বাচনের আগে তাতে কোনো হাত দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।

আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ একটি সংশোধনী আনে। এতে শুধুমাত্র ব্যক্তিকে বিচারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকার বলছে, স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনকে বিচারের আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। পরের বছর ২০১৪ সালে আইন মন্ত্রণালয় আইনটি সংশোধনে উদ্যোগ নিলেও তাতে দৃশ্যমান কিছু চোখে পড়েনি।

এদিকে ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর গত ১৩ বছরে ৫১ টি মামলার রায় হয়েছে। এতে দণ্ডপ্রাপ্ত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনের মৃত্যুদন্ডের রায় হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৪ জন পলাতক রয়েছেন। ছয়জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। আর তদন্ত শেষ হয়েছে ৩৫ টি মামলার। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে ৪০টি আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির রায় পুর্নবিবেচনার আবেদন বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া ৫১ মামলায় খালাস পেয়েছেন মাত্র দুই জন আসামি। এসব মামলায় মোট ১৫১ আসামির মধ্যে ১৩১ জন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। রায় হওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় কারাগারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১৮ জন। আর পলাতক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন আরও দুই জন।